অমৃতের মৃত্যু

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হয়তো তাই। এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আজ বিকেলে তাঁর ভগিনীপতির সঙ্গে দেখা হলে হয়তো তাঁর প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে। আচ্ছা‌, আজ চলি‌, আবার দেখা হবে।’

দ্বার পর্যন্ত আসিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া গেল‌, বিশুবাবুর পাশে দাঁড়াইয়া হ্রস্বকণ্ঠে বলিল‌, ‘একটা কথা জিগ্যেস করা হয়নি। আপনি কি সম্প্রতি কোনো বেনামী চিঠি পেয়েছেন?’

বিশুবাবু চকিতে মুখ তুলিলেন‌, ‘ পেয়েছি। আপনি কি করে জানলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আরও দু’একজন পেয়েছে‌, তাই মনে হল হয়তো আপনিও পেয়েছেন। কী আছে বেনামী চিঠিতে? ভয় দেখানো?’

‘এই—যে দেখুন না-বলিয়া বিশুবাবু দেরাজ হইতে আমাদেরই লেখা চিঠি বাহির করিয়া দিলেন।’

ব্যোমকেশ মনোযোগ দিয়া চিঠি পড়িল‌, তারপর চিঠি ফেরত দিয়া বলিল‌, ‘হুঁ। কে লিখেছে কিছু আন্দাজ করতে পারেন না?’

বিশুবাবু বলিলেন‌, ‘কিছু না। আমার জীবনে এমন কোনও গুপ্তকথা নেই। যা ভাঙিয়ে কেউ লাভ করতে পারে?’

‘আপনার শত্রু কেউ আছে?–

‘অনেক। ব্যবসাদারের সবাই শত্ৰু।’

‘তাহলে তারাই কেউ হয়তো নিছক mischief করবার জন্যে চিঠি দিয়েছে।–চলি এবার। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’

বিশুবাবু হাসিয়া বলিলেন‌, ‘আমার মিল তাহলে সার্চ করছেন না?’

ব্যোমকেশও হাসিল‌, ‘অনর্থক পণ্ডশ্রম করে লাভ কি‌, বিশ্বনাথবাবু?’

‘আর জঙ্গল?’

‘সেটাও আজ নয়-জঙ্গল আপাদমস্তক খুঁজতে অনেক কাঠ-খড়ি চাই। এস অজিত‌, রোদ ক্রমেই কড়া হচ্ছে। বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর সঙ্গে দুটো কথা বলে চট্বপট আস্তানায় ফিরতে হবে।’

বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর সঙ্গে আলাপ করিয়া কিন্তু সুখ হইল না।

মাড়োয়ারীদের মধ্যে প্রধানত দুই শ্রেণীর চেহারা দেখা যায়; এক‌, পাতিহাসের মত মোটা আর বেঁটে; দুই‌, বকের মত সরু আর লম্বা। বদ্রিদাসের আকৃতি দ্বিতীয় শ্রেণীর। তাঁহার চালের কলটি আকারে প্রকারে বিশুবাবুর মিল-এর অনুরূপ; সেই ধান শুকাইবার মেঝে‌, সেই পুকুর‌, সেই ইঞ্জিন-ঘর‌, সেই ফটকের সামনে গুখ দারোয়ান। পৃথিবীর সমস্ত চাল কলের মধ্যে বোধ করি আকৃতিগত ভ্রাতৃসম্বন্ধ আছে।

বদ্রিদাসের বয়স পয়ত্ৰিশ হইতে চল্লিশের মধ্যে। নিজের গদিতে বসিয়া খবরের কাগজ হইতে তেজি-মন্দার হাল জানিতেছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া এবং পরিচয় শুনিয়া তাঁহার চক্ষু দুইটি অতিমাত্রায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। তিনি গলা উচু করিয়া ঘরের আনাচে-কানাচে চকিত ক্ষিপ্র নেত্রপাত করিতে লাগিলেন‌, কিন্তু আমাদের সঙ্গে পলকের তরেও দৃষ্টি বিনিময় করিলেন না। ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তরে তিনি যাহা বলিলেন তাহাও নিতান্ত সংক্ষিপ্ত এবং নেতিবাচক। পুরা সওয়াল জবাব উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নাই‌, নমুনাস্বরূপ কয়েকটির উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে।–

‘আপনি অমৃতকে চিনতেন?’

‘নেহি।’

সদানন্দ সুরকে চিনতেন?’

‘নেহি।’

‘বেনামী চিঠি পেয়েছেন?’

‘নেহি।’

‘আপনার কলো রঙের ঘোড়া আছে?’

‘নেহি।’

আরও কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তরের পর ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল‌, কঠিন দৃষ্টিতে বদ্রিদাসকে বিদ্ধ করিয়া বলিল‌, ‘আজ চললাম‌, কিন্তু আবার আসব। এবার ওয়ারেন্ট নিয়ে আসব‌, আপনার মিল সার্চ করব।’

বদ্রিদাস এককথার মানুষ‌, দুরকম কথা বলেন না। বলিলেন‌, ‘নেহি‌, নেহি।’

উত্ত্যক্ত হইয়া চলিয়া আসিলাম। ফটকের বাহিরে পা দিয়াছি‌, একটি শীর্ণকায় বাঙালী আসিয়া আমাদের ধরিয়া ফেলিল; পানের রসে আরক্ত দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল‌, ‘আপনি ব্যোমকেশবাবু? বদ্রিদাসকে সওয়াল করছিলেন?’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘আপনি জানলেন কি করে? ঘরে তো কেউ ছিল না।’

রক্তদন্ত আরও প্রকট করিয়া লোকটি বলিল‌, ‘আমি আড়াল থেকে সব শুনেছি। বদ্রিদাস আগাগোড়া মিছে কথা বলেছে। সে অমৃতকে চিনত‌, সদানন্দ সুরকে চিনত‌, বেনামী চিঠি পেয়েছে‌, ওর কালো রঙের একটা ঘোড়া আছে। ভারি ধূর্ত মাড়োয়ারী‌, পেটেপেটে শয়তানি।’

ব্যোমকেশ লোকটিকে কিছুক্ষণ শান্তচক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনি কে?’

‘আমার নাম রাখাল দাস। মাড়োয়ারীর গদিতে কাজ করি।’

‘আপনার চাকরি যাবার ভয় নেই?’

‘চাকরি গিয়েছে। বদ্রিদাস লুটিস দিয়েছে‌, এই মাসের শেষেই চাকরি খালাস।’

‘নোটিস দিয়েছে কেন?’

‘মুলুক থেকে ওর জাতভাই এসেছে‌, তাকেই আমার জায়গায় বসাবে। বাঙালী রাখবে না।’ আমরা চলিতে আরম্ভ করিলাম। লোকটা আমাদের পিছন পিছন আসিতে লাগিল‌, ‘মনে রাখবেন ব্যোমকেশবাবু্‌, পাজির পা-ঝাড়া ওই বদ্রিদাস। ওর অসাধ্যি কৰ্ম্ম নেই। জাল জুচ্চুরি কালাবাজার–‘

ব্যোমকেশ পিছন ফিরিয়া চাহিল না‌, হাত নাড়িয়া তাহাকে বিদায় করিল।

বিশ্রান্তিগুহে ফিরিয়া ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় লম্বা হইল‌, ঊর্ধ্বে চাহিয়া বোধকরি ভগবানের উদ্দেশে বলিল‌, ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি?

আমি জামা খুলিয়া বিছানার পাশে বসিলাম; বলিলাম, ব্যোমকেশ, অনেক লোকের সঙ্গেই তোতো মুলাকাৎ করলে। কিছু বুঝলে?’

সে বলিল‌, ‘বুঝেছি। সবই। কিন্তু লোকটিকে যতক্ষণ নিঃসংশয়ে চিনতে না পারছি ততক্ষণ বোঝাবুঝির কোনও মানে হয় না।’

‘কালো ঘোড়ার ব্যাপারটা কি? বদ্রিদাসের যদি কালো ঘোড়া থাকেই তাতে কী?’

ব্যোমকেশ কতক নিজ মনে বলিল‌, ‘খাট্‌কা লাগছে। বদ্রিদাসের কালো ঘোড়া-খট্‌কা লাগছে!’

‘তোমার ধারণা হত্যাকারী কালো ঘোড়ায় চড়ে সদানন্দ সুরকে খুন করতে গিয়েছিল। কিন্তু কেন? ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে লাভ কি?’

‘লাভ আছে‌, কিন্তু লোকসানও আছে। তাই ভাবছি—। যাক।’ সে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল‌, ‘বিশ্বনাথ মল্লিককে কেমন দেখলে?’

0 Shares