অমৃতের মৃত্যু

বলিলাম‌, ‘জিকি ছিলেন‌, কুকুরের চেয়ে ঘোড়া ভালবাসেন; এ থেকে ভালোমন্দ কিছু বুঝলাম না। কিন্তু ওঁকে হাঁড়ির খবর দেওয়া কি উচিত হয়েছে? মনে করো‌, জঙ্গল সার্চ করার কথাটা যদি বেরিয়ে যায়! আসামী সাবধান হবে না?’

ব্যোমকেশ একটু বিমনাভাবে বলিল‌, ‘হুঁ। কিন্তু আমি তাঁকে চেতিয়ে দিয়েছি‌, আমার বিশ্বাস তিনি কাউকে বলবেন না।’

‘কিন্তু যদি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়!’

‘তাহলে ভাবনার কথা বটে।–যাক‌, নীলকণ্ঠ অধিকারীকেও বেশ সরল প্রকৃতির লোক বলে মনে হয়। ভারি প্রভুভক্ত‌, কী বলো?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু রাখাল দাস?’

‘ও একটা খুঁচো। বদ্রিদাস তাড়িয়ে দিয়েছে‌, তাই গায়ের ঝাল মেটাতে এসেছিল।’

‘কিন্তু ওর কথাগুলো কি মিথ্যে?’

‘না‌, সব সত্যি।’

দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া লইলাম। ব্যোমকেশের মুখখানা সারাক্ষণ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হইয়া রহিল। উদ্বেগের হেতুটা কিন্তু ঠিক ধরিতে পারিলাম না।

বেলা সাড়ে চারটের সময় রামডিহি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বাহির হইলাম। পৌঁনে-পাঁচটায় গাড়ি‌, পাঁচটা বাজিয়া দশ মিনিটে রামডিহি পৌঁছিবে। প্রাণকেষ্ট পালের সহিত সদালাপ করিয়া ফিরিতে বেশি রাত হইবে না।

টিকিট কিনিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করিলাম। ফটকে মনোতোষ টিকিট চেক করিয়া মিটমিটি হাসিল‌, ‘ফিরছেন কখন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘নটা-দশটা হবে।’

প্ল্যাটফর্মে কিছু যাত্রী সমাগম হইয়াছে। ট্রেন আসিতে মিনিট পাঁচেক দেরি আছে। এদিক ওদিক দৃষ্টি ফিরাইতে চোখে পড়িল ক্ষীণাঙ্গ স্টেশনমাস্টার হরিবিলাসবাবুর অফিসের সামনে পীনাঙ্গ দারোগা সুখময়বাবু তাঁহার সহিত সতর্কভাবে কথা বলিতেছেন। সুখময়বাবু আমাদের দেখিতে পাইয়া হাত নাড়িলেন এবং অল্পক্ষণ পরেই আসিয়া হাজির হইলেন। তাঁহার চোখে অনুসন্ধিৎসার ঝিলিক।

‘কোথাও যাচ্ছেন নাকি?’

‘রামডিহি যাব‌, একটু কাজ আছে। আপনি?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘আমি কোথাও যাব না। একজনকে এগিয়ে নিতে এসেছি। এই ট্রেনেই তিনি আসছেন। হো-হে।’ বলিয়া ভ্রূ নাচাইলেন।

ব্যোমকেশ একটু বিস্মিতম্বরে বলিল‌, ‘কে তিনি?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘তাঁর নাম নফর কুণ্ডু। তাঁর কয়েক বস্তা চাল রেলে চালান যাচ্ছিল‌, একটা বস্তা ট্রেনের ঝাঁকানিতে ফেটে গিয়ে ভেতর থেকে দু’সের আফিম বেরিয়েছে। নফর কুণ্ডুও ধরা পড়েছেন। এই ট্রেনে তিনি আসছেন।’ বলিয়া ভ্রূ নাচাইতে নাচাইতে স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে প্রস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ ললাট কুঞ্চিত করিয়া চৌকা-পাথর-ঢাকা প্ল্যাটফর্মের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি বলিলাম‌, ‘ওহে‌, বদ্রিদাস মাড়োয়ারীও এসেছেন।’

ব্যোমকেশ চকিতে চোখ তুলিল। মালগুদামের দিক হইতে বকের মত পা ফেলিয়া শনৈঃ শনৈঃ বদ্রিদাস আসিতেছেন। তাঁহার ভাবভঙ্গী হইতে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি আমাদের দেখিতে পাইয়াছেন। কিন্তু তিনি আমাদের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন না‌, ধীর মন্থর পদে প্ল্যাটফর্ম হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

ব্যোমকেশের ভূ-কুঞ্চন আরও গভীর হইল।

মিনিটখানেক পরে আমি বলিলাম‌, ‘ওহে‌, বিশুবাবুও উপস্থিত। কী ব্যাপার বলে দেখি?

যোধপুরী ব্রিচেস পরা বিশুবাবু ফটক দিয়া প্রবেশ করিলেন‌, আমাদের দেখিতে পাইয়া স্মিতমুখে আগাইয়া আসিলেন।

নমস্কার। কোথাও যাচ্ছেন?’

‘রামডিহি যাচ্ছি।’

‘ওহো-সদানন্দ সুরের ভগিনীপতি।’

‘হ্যাঁ। দশটার মধ্যেই ফিরব। আপনি?’

‘একটা চালান আসবার কথা আছে‌, তারই খোঁজ নিতে এসেছি। দেখি যদি এসে থাকে।’ অস্থিসার মুখে একটু হাসিয়া তিনি মাল-অফিসের দিকে চলিয়া গেলেন।

ইতিমধ্যে ট্রেনের ধোঁয়া দেখা দিয়াছিল। অবিলম্বে প্যাসেঞ্জার গাড়ি আসিয়া পড়িল। গাড়িতে উঠিবার আগে লক্ষ্য করিলাম‌, একটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরা হইতে পুলিস-পরিবৃত একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি অবতরণ করিলেন। অনুমান করিলাম ইনি আফিম-বিলাসী নফর কুণ্ডু। মনে পাপ ছিল বলিয়াই বোধহয় বেনামী চিঠি পাইয়া গা-ঢাকা দিয়াছিলেন।

দুই তিন মিনিট পরে গাড়ি ছাড়িয়া দিল। ব্যোমকেশের মুখে সংশয়ের ভ্রূকুটি গাঢ়তার হইয়াছে‌, যেন সে হঠাৎ কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হইয়া মানস্থির করিতে পারিতেছে না। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘হল কি? ঠেকায় পড়েছি মনে হচ্ছে।’

সে উত্তর দিবার আগেই ঘ্যাঁচ করিয়া গাড়ি থামিয়া গেল। জানোলা দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিলাম ডিস্টান্ট সিগনাল না পাইয়া গাড়ি থামিয়াছে। তারের বেড়ার ওপারে বাঘমারি গ্রাম দেখা যাইতেছে।

যেন সমস্ত সমস্যার সমাধান হইয়াছে এমনিভাবে লাফাইয়া উঠিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভালোই হল। অজিত‌, আমি এখানে নেমে যাচ্ছি‌, তুমি একই রামডিহি যাও। প্রাণকেষ্টবাবুকে সব কথা জিগ্যেস করবে। সদানন্দবাবু তাঁর কাছে তোরঙ্গ রেখে গিয়েছিলেন। কিনা এ-কথাটা জানতে ভুলো না।–আচ্ছা।’

গাড়ি সিটি মারিয়া আবার গুটিগুটি চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল‌, ব্যোমকেশ নামিয়া পড়িল। আমি হতবুদ্ধি হইয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিলাম। সে তারের বেড়া পার হইয়া আমার উদ্দেশে একবার হাত নাড়িল‌, তারপর বাঘমারি গ্রামের দিকে চলিল।

ইতিপূর্বে ব্যোমকেশ কখনও আমাকে এমনভাবে ফেলিয়া পালায় নাই। মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। প্রাণকেষ্টবাবুকে কী জেরা করিব? ব্যোমকেশ যখন জেরা করে তখন তাহার প্রয়োগনৈপুণ্য উপভোগ করিতে পারি‌, কিন্তু নিজে এ-কাজ কখনও করি নাই। শেষে কি ধাষ্টামো করিয়া বসিব! ব্যোমকেশ আমাকে একি আতান্তরে ফেলিয়া গেল!

0 Shares