প্যাসেঞ্জার গাড়ি দুলকি চালে চলিয়াছে; দু’তিন মাইল অন্তর ছোট ছোট স্টেশন, তবু অবিলম্বে গাড়ি রামডিহি পৌঁছিবে। সুতরাং এইবেলা মাথা ঠাণ্ডা করিয়া ভাবিয়া লওয়া দরকার। প্রথমেই ভাবিতে হইবে, প্রাণকেষ্টবাবুকে ব্যোমকেশ জেরা করিতে চায় কেন? প্রাণকেষ্টবাবু সদানন্দ সুরের ভগিনীপতি, সম্ভবত প্ৰাণকেষ্টবাবুর স্ত্রী সদানন্দবাবুর উত্তরাধিকারিণী, কারণ সদানন্দবাবুর নিকট আত্মীয় আর কেহ নাই। …সদানন্দবাবু কলিকাতা যাইবার পথে কি ভগিনীপতির কাছে লোহার তোরঙ্গ রাখিয়া গিয়াছিলেন? তেরঙ্গে কি কোনও মহামূল্য দ্রব্য ছিল? প্রাণকেষ্টবাবু কর্মসূত্রে এই পথ দিয়া ট্রলি চড়িয়া যাতায়াত করিতেন; তাঁহার পক্ষে ট্রলি হইতে নামিয়া বাঘমারি গ্রামে উপস্থিত হওয়া মোটেই শক্ত নয়। তবে কি বোমকেশের সন্দেহ প্রাণকেষ্টবাবুই শ্যালককে সংহার করিয়াছেন?…
রামডিহি জংশনে পৌঁছিয়া প্ৰাণকেষ্ট পালের ঠিকানা পাইতে বিলম্ব হইল না। স্টেশনের সন্নিকটে তারের বেড়া দিয়া ঘেরা কয়েকটি ছোট ছোট কুঠি, তাহারই একটাতে প্ৰাণকেষ্টবাবু বাস করেন। কুঠির সামনে ছোট্ট বাগান; প্যান্টুলুন ও হাত-কটা গেঞ্জি পরা একটি পুষ্টকায় ব্যক্তি মুক্ত দি ইয়া বাগানের পরিচর্য করতেছিলেন, আমাকে দেখিয়া ফ্যালকাল চক্ষে চাহিয়া রহিলেন।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনিই কি প্ৰাণকেষ্ট পাল?’
তাঁহার হাত হইতে খুরপি পড়িয়া গেল। তিনি কিছুক্ষণ হ্যাঁ করিয়া থাকিয়া বিহুলভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িলেন। বলিলাম, ‘আমি পুলিসের পক্ষ থেকে আসছি। খবর পেয়েছেন। বোধহয় আপনার শালা সদানন্দ সুর মারা গেছেন।’
এই প্রশ্নে ভদ্রলোক এমন স্তম্ভিত হইয়া গেলেন যে, মনে হইল তাঁহার প্যান্টুলুন। এখনি খসিয়া পড়িবে। তারপর তিনি চমকিয়া উঠিয়া ‘সুশীলা! সুশীলা? বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলেন।
আমিও কম স্তম্ভিত হই নাই। মনে-মনে যাহাকে দুদন্তি শ্যালক-হস্তা বলিয়া আঁচ করিয়াছি, তাঁহার এইরূপ আচার-আচরণ! পুলিসের নাম শুনিয়াই শিথিলাঙ্গ হইয়া পড়িলেন! কিংবা-এটা একটা ভান মাত্র। ঘাগী অপরাধীরা পুলিসের চোখে ধূলা দিবার জন্য নানাপ্রকার ছলচাতুরি অবলম্বন করে-প্রাণকেষ্টবাবু কি তাহাই করিতেছেন? সুশীলাই বা কে? তাঁহার স্ত্রী?
পাঁচ মিনিট কাটিয়া গেল, বাড়ির ভিতর হইতে সাড়াশব্দ নাই। অতঃপর কি করিব, ডাকাডাকি করিব কি ফিরিয়া যাইব, এইসব ভাবিতেছি, এমন সময় দ্বারের কাছে প্ৰাণকেষ্টবাবুকে দেখা গেল। তিনি যেন কতকটা ধাতস্থ হইয়াছেন, প্যান্টুলুন যথাস্থানে আছে বটে, কিন্তু হাত-কটা গেঞ্জির উপর বুশ–কোটি চড়াইয়াছেন। মুখে মুমূর্ষ হাসি আনিয়া বলিলেন, ‘আসুন।’
সামনের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলাম।। ঘরটি ছোট, কয়েকটি সস্তা বেতের চেয়ার ও টেবিল দিয়া সাজানো, অন্দরে যাইবার দরজায় পদাৰ্ণ; বিলিতি অনুকৃতির মধ্যেও একটু পরিচ্ছন্নতা আছে। আমি অন্দরে যাইবার দরজার দিকে পিছন করিয়া বসিলাম, প্ৰাণকেষ্টবাবু আমার মুখোমুখি বসিলেন।
শুরু করিলাম, ‘আপনার শালা সদানন্দবাবুর মৃত্যু-সংবাদ পেয়েছেন তাহলে?’
প্ৰাণকেষ্ট চমকিয়া বলিলেন, ‘অ্যাঁ-হাঁ।’
‘কখন খবর পেলেন?’
‘অ্যাঁ-সকালবেলা।’
‘কার মুখে খবর পেলেন?’
‘অ্যাঁ -সন্তালগোলা থেকে হরিবিলাসবাবু টেলিফোন করেছিলেন।’
‘মাফ করবেন, আপনার স্ত্রী, মানে সদানন্দবাবুর ভগ্নী কি এখানে আছেন?’
দেখিলাম আমার প্রশ্নের উত্তর দিবার আগে প্রাণকেষ্টবাবুর চক্ষু দু’টি আমার মুখ ছাড়িয়া আমার পিছন দিকে চলিয়া গেল এবং তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিল।
‘হ্যাঁ–আছেন।’
আমি পিছনে ঘাড় ফিরাইলাম। অন্দরের পর্দা একটু ফাঁক হইয়া ছিল, চকিতে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট হইল। বুঝিতে বাকি রহিল না, পর্দার আড়ালে আছেন পত্নী সুশীলা এবং নেপথ্য হইতে প্রাণকেষ্টবাবুকে পরিচালিত করিতেছেন।
‘আপনার স্ত্রী নিশ্চয় খুব শোক পেয়েছেন?’
আবার প্রাণকেষ্টবাবুর চকিতচক্ষু পিছন দিকে গিয়া ফিরিয়া আসিল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়, খুব শোক পেয়েছেন।’
‘আপনার স্ত্রী সদানন্দবাবুর উত্তরাধিকারিণী?
‘তা–তা তো জানি না। মানে–’
‘সদানন্দবাবুর সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব সদ্ভাব ছিল।’
‘যাওয়া-আসা ছিল?’
‘তা ছিল বৈকি! মানে–’
তাঁহার চক্ষু আবার পদার পানে ধাবিত হইল, ‘অ্যা-মানে—বেশি যাওয়া-আসা ছিল না। কালেভদ্ৰে—’
‘শেষ কবে দেখা হয়েছে?’
‘শেষ? অ্যাঁ–ঠিক মনে পড়ছে না–’
‘দশ-বারো দিন আগে তিনি আপনার বাসায় আসেননি?’
প্রাণকেষ্টবাবুর চক্ষু দু’টি ভয়ার্ত হইয়া উঠিল, ‘কৈ না তো! ‘
‘তিনি কলকাতা যাবার আগে আপনার কাছে একটা স্টীলের ট্রাঙ্ক রেখে যাননি?
প্রাণকেষ্টবাবুর দেহ কাঁপিয়া উঠিল, ‘না, না, স্টীলের ট্রাঙ্ক-না না, কৈ আমি তো কিছু—’
আমি কড়া সুরে বলিলাম, আপনি এত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কেন?
‘নার্ভাস! না না।–’
পর্দা সরাইয়া প্রাণকেষ্টবাবুর স্ত্রী প্রবেশ করিলেন। স্বামীর চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন, ‘আমার স্বামী নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ, অচেনা লোক দেখলে আরও নার্ভাস হয়ে পড়েন। আপনি কি জানতে চান আমাকে বলুন।’
মহিলাকে দেখিলাম। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, দৃঢ়গঠিত দেহ, চোয়ালের হাড় মজবুত, চোখের দৃষ্টি প্রখর। মুখমণ্ডলে ভ্ৰাতৃশোকের কোনও চিহ্নই নাই। তিনি যে অতি জবরদস্ত মহিলা তাহা বুঝিতে তিলার্ধ বিলম্ব হইল না। আমি উঠিয়া পড়িলাম, ‘আমার যা জানবার ছিল জেনেছি, আর কিছু জানবার নেই। নমস্কার।’ শ্ৰীমতী সুশীলাকে জেরা করা আমার কর্ম নয়।