স্টেশনে গিয়া জানিতে পারিলাম, ন’টার আগে ফিরিবার ট্রেন নাই। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা কাটাইবার জন্য স্টেশনের স্টলে চা খাইলাম, অসংখ্য সিগারেট পোড়াইয়া প্ল্যাটফর্মে পাদচারণ করিলাম, এবং সস্ত্রীক প্রাণকেষ্টবাবুর কথা চিন্তা করিলাম।
প্ৰাণকেষ্ট পাল নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ হইতে পারেন; কিন্তু তিনি যে আমাকে দেখিয়া এত বেশি নার্ভাস হইয়া পড়িয়াছিলেন তাহা কেবল ধাতুগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা নয়, অন্য কারণও আছে। কী সে কারণ? প্ৰাণকেষ্ট পত্নীর ইশারায় আমার কাছে অনেকগুলা মিথ্যাকথা বলিয়াছিলেন। কী সে মিথ্যাকথা? সদানন্দ সুরের সহিত বেশি সম্প্ৰীতি না থাক, সদানন্দ সুর তাঁহার বাড়িতে যাতায়াত করিতেন। দশ-বারো দিন আগে কলিকাতায় যাইবার মুখে তিনি স্টীলের ট্রাঙ্কটি নিশ্চয় ভগিনীপতির গৃহে রাখিয়া গিয়াছিলেন। ট্রাঙ্কে নিশ্চয় কোনও মূল্যবান দ্রব্য ছিল। কী মূল্যবান দ্রব্য ছিল? টাকাকড়ি? গহনা? বোমাবারুদ? আন্দাজ করা শক্ত। কিন্তু শ্ৰীমতী সুশীলা বাক্সে কী আছে জানিবার কৌতুহল সংবরণ করিতে পারেন নাই, হয়তো তালা ভাঙিয়াছিলেন। তাঁহার মত জবরদস্ত মহিলার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু তারপর? তারপর হয়তো ট্রাঙ্কে এমন কিছু পাওয়া গেল যে সদানন্দ সুরকে খুন করা প্রয়োজন হইল। হয়তো ট্রাঙ্কে হ্যান্ড-গ্রিনেড ছিল, সেই হ্যান্ড-গ্রিনেড দিয়াই সদানন্দকে–
কিন্তু না। শ্ৰীমতী সুশীলা যত দুর্ধর্ষ মহিলাই হোন, নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে খুন করিবেন? আর প্রাণকেষ্ট পালের পক্ষে এরূপ দুঃসাহসিক কার্যে লিপ্ত হওয়া একেবারেই অসম্ভব। …কিন্তু স্টেশনমাস্টার হরিবিলাসবাবু বন্ধুকে অশুভ সংবাদটা সাত-তাড়াতাড়ি দিতে গেলেন কেন? বন্ধুসুলভ সহানুভূতি?…
সাড়ে ন’টার সময় সান্তালগোলায় ফিরিলাম। আকাশে চাঁদ আছে, শহর-বাজার নিযুতি হইয়া গিয়াছে। ভাবিয়ছিলাম বিশ্রান্তি গৃহে আসিয়া দেখিব ব্যোমকেশ ফিরিয়াছে। কিন্তু তাহার দেখা নাই। কোথায় গেল সে?
বিশ্রান্তিগৃহের চাকরটা রন্ধন শেষ করিয়া বারান্দায় বসিয়া ঢুলিতেছিল, তাহাকে খাবার ঢাকা দিয়া গৃহে ফিরিয়া যাইতে বলিলাম। সে চলিয়া গেল।
কেরোসিনের বাতি কমাইয়া দিয়া বিছানায় অঙ্গ প্রসারিত করিলাম। পিছনের জানোলা দিয়া চাঁদের আলো আসিতেছে। …কোথায় গেল ব্যোমকেশ? বলা নাই কহা নাই ট্রেন হইতে নামিয়া চলিয়া গেল। বাঘামারি গ্রামে তার কী কাজ? এতক্ষণ সেখানে কী করিতেছে?
ঘুমাইয়া পড়িয়ছিলাম; ঘুম ভাঙিল। কানের কাছে ব্যোমকেশের ফিসফিস গলার শব্দে, ‘অজিত, ওঠে, একটা জিনিস দেখবে এস।’
ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম, ‘কী-?’
‘চুপ! আস্তে!’ ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া আমাকে বিছানা হইতে নামাইল, তারপর পিছনের জানালার দিকে টানিয়া লইয়া গেল; বাহিরের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল, ‘দেখছ?’
ঘুমের ঘোর তখনও ভালো করিয়া কাটে নাই, ব্যোমকেশের ভাবভঙ্গী দেখিয়া মনে হইয়াছিল না জানি কী দেখিব! কিন্তু যাহা দেখিলাম তাহাতে বোকার মত চাহিয়া রহিলাম। জানালা হইতে পনেরো-কুড়ি হাত দূরে ঝোপঝাড় আগাছার মাঝখানে খানিকটা মুক্ত স্থান, সেইখানে ছয়-সাতটা কৃষ্ণবৰ্ণ জন্তু অর্ধবৃত্তাকারে বসিয়া ঘাড় উচু করিয়া চাঁদের পানে চাহিয়া আছে। প্রথম দর্শনে মনে হইল কৃষ্ণকায় কয়েকটা কুকুর। বলিলাম, ‘কালো কুকুর।’ কিন্তু পরীক্ষণেই যখন তাহারা সমস্বরে হুক্কা-হুয়া করিয়া উঠিল, তখন আর সংশয় রহিল না। স্থানীয় শৃগালের দল চন্দ্রালোকে সঙ্গীত-সভা আহ্বান করিয়াছে।
আমার মুখের ভাব দেখিয়া ব্যোমকেশ হো-হো শব্দে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। শৃগালের দল চমকিয়া পলায়ন করিল। আমি বলিলাম, ‘এর মানে? দুপুর রাত্রে আমাকে শেয়াল দেখাবার কী দরকার ছিল?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আগে কখনও চাঁদের আলোয় শেয়াল দেখেছ?’
‘চাঁদের আলোয় শেয়াল দেখলে কী হয়?’
‘পুণ্য হয়, অজ্ঞান তিমির নাশ হয়! আমার মনে যেটুকু সংশয় ছিল তা এবার দূর হয়েছে। চলো এখন খাওয়া যাক, পেট চুঁই-চুঁই করছে।’
আলো বাড়াইয়া দিয়া টেবিলে খাইতে বসিলাম। লক্ষ্য করিলাম, ব্যোমকেশ ক্ষুধার্তভাবে অন্নগ্ৰাস মুখে পুরিতেছে বটে, কিন্তু তাহার মুখ হযোৎফুল্ল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এত ফুর্তি কিসের? দুপুর রাত পর্যন্ত ছিলে কোথায়? বাঘমারিতে?
সে বলিল, ‘বাঘমারির কাজ ন’টার মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর–’
‘বাঘমারিতে কী কাজ ছিল?’
‘পটল, দাশু আর গোপালের সঙ্গে কাজ ছিল।’
‘হুঁ, কী কাজ ছিল বলবে না। যাক, তারপর?’
‘তারপর সান্তালগোলায় ফিরে এসে সুখময় দারোগার কাছে গেলাম। সেখানে একঘণ্টা কাটল। তারপর গেলাম স্টেশনে। হরিবিলাসবাবু ছিলেন না, তাঁকে বিছানা থেকে ধরে নিয়ে এলাম। লম্বা টেলিফোন করতে হল। এখানকার থানায় পাঁচটি বৈ লোক নেই। কাল সকালে বাইরে থেকে দশজন আসবে। সব ব্যবস্থা করে ফিরে এলাম।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘প্ৰাণকেষ্ট পালের কথা জানিবার দরকার নেই তাহলে?’
‘আছে বৈকি। কি হল সেখানে?’
সব কথা মাছিমারা ভাবে বয়ান করিলাম। সে মন দিয়া শুনিল, কিন্তু বিশেষ আগ্রহ দেখাইল না। আহারান্তে মুখ ধুইতে ধুইতে বলিল, ‘জোড়ার একটা যদি হয় গবেট, অন্যটা হয় বিছু। প্রকৃতির এই বিধান।’
অতঃপর সিগারেট ধরানো হইলে বলিলাম, ‘তোমার পকেটে ওটা কি?’
ব্যোমকেশ একটু চকিত হইল, একটু লজ্জিত হইল। বলিল, ‘বন্দুক-মানে, পিস্তল।’
‘কোথায় পেলে?’
‘থানায়। সুখময় দারোগার পিস্তল।’