পটল বলিল, ‘হ্যাঁরে অমর্ত, তুই এতবড় বীর, নাদুর সঙ্গে লড়ে যেতে পারলি না? নারকেল গাছে উঠলি।’
অমৃত বলিল, ‘আিৰ্হঃ, আমি তো ডাব পড়তে উঠেছিলাম। নেদোকে আমি ডরাই না, ওর হাতে যদি লাঠি না থাকত। অ্যায়সা লেঙ্গি মারতাম যে বাছাধনকে বিছানায় পড়ে কো-কোঁ করতে হত!’
গোপাল বলিল, ‘শাবাশ! বাড়ি গিয়ে মামার কাছে খুব ঠেঙানি খেয়েছিলি তো?’
অমৃত হাত মুখ নাড়িয়া বলিল, ‘মামা মারেনি, মামা আমাকে ভালবাসে। শুধু মামী কান মলে দিয়ে বলেছিল—তুই একটা গো-ভূত।’
সকলে হি-হি করিয়া হাসিল। পটল বলিল ছিছি, তুই এমন কাপুরুষ! মেয়েমানুষের হাতের কানমলা খেলি?’
অমৃত বলিল, ‘মামী গুরুজন, তাই বেঁচে গেল, নইলে দেখে নিতাম। আমার সঙ্গে চালাকি নয়।’
দাশু বলিল, ’আচ্ছা অম্রা, তুই তো মানুষকে ভয় করিস না। সত্যি বল দেখি, ভূত দেখলে কি করিস?’
একজন নিম্নস্বরে বলিল, ‘কাপড়ে-চোপড়ে–’
অমৃত চোখ পাকাইয়া বলিল, ‘ভূত আমি দেখেছি। কিন্তু মোটেই ভয় পাইনি।’।
সকলে কলরব করিয়া উঠিল, ‘ভূত দেখেছিস? কবে দেখলি? কোথায় দেখলি?’
অমৃত সগর্বে জঙ্গলের দিকে শীর্ণ বাহু প্রসারিত করিয়া বলিল, ‘ঐখানে।’
‘কবে দেখেছিস? কী দেখেছিস?’
অমৃত গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘ঘোড়া-ভূত দেখেছি।’
দু’একজন হাসিল। গোপাল বলিল, ‘তুই গো-ভূত কিনা, তাই ঘোড়া-ভূত দেখেছিস। কবে দেখলি?’
‘পরশু রাত্তিরে।’ অমৃত পরশু রাত্রের ঘটনা বলিল, ‘আমাদের কৈলে বাছুরটা দড়ি খুলে গোয়ালঘর থেকে পালিয়েছিল। মামা বললে, যা আমরা, জঙ্গলের ধারে দেখে আয়। রাত্তির তখন দশটা; কিন্তু আমার তো ভয়-ডর নেই, গেলাম জঙ্গলে। এদিক ওদিক খুঁজলাম, কিন্তু কোথায় বাছুর। চাঁদের আলোয় জঙ্গলের ভেতরটা হিলি-বিলি দেখাচ্ছে–হঠাৎ দেখি একটা ঘোড়া। খুরের শব্দ শুনে ভেবেছিলাম বুঝি বাছুরটা; ঘাড় ফিরিয়ে দেখি একটা ঘোড়া বনের ভেতর দিয়ে সাঁ করে চলে গেল। কালো কুচকুচে ঘোড়া, নাক দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। আমি রামনাম করতে করতে ফিরে এলাম। রামনাম জপলে ভূত আর কিছু বলতে পারে না।’
দাশু জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন দিক থেকে কোন দিকে গেল ঘোড়া-ভূত?’
‘গায়ের দিক থেকে ইস্টিশানের দিকে।’
‘ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ছিল?’
‘অত দেখিনি।’
সকলে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। ভূতের গল্প বানাইয়া বলিতে পারে এত কল্পনাশক্তি অমৃতের নাই। নিশ্চয় সে জ্যান্ত ঘোড়া দেখিয়াছিল। কিন্তু জঙ্গলে ঘোড়া আসিল কোথা হইতে? গ্রামে কাহারও ঘোড়া নাই। যুদ্ধের সময় যে মার্কিন সৈন্য জঙ্গলে ছিল তাহদের সঙ্গেও ঘোড়া ছিল না। ইস্টিশনের গঞ্জে দুই-চারিটা ছ্যাকড়া-গাড়ির ঘোড়া আছে বটে। কিন্তু ছ্যাকড়া-গাড়ির ঘোড়া রাত্ৰিবেলা জঙ্গলে ছুটাছুটি করিবে কেন? তবে কি অমৃত পলাতক বাছুরটাকেই ঘোড়া বলিয়া ভুল করিয়াছিল?
অবশেষে পটল বলিল, ‘বুঝেছি, তুই বাছুর দেখে ঘোড়া-ভূত ভেবেছিলি।’
অমৃত সজোরে মাথা ঝাঁকাইয়া বলিল, ‘না না, ঘোড়া। জলজ্যান্ত ঘোড়া-ভূত আমি দেখেছি।’
‘তুই বলতে চাস ঘোড়া-ভূত দেখেও তোর দাঁত-কপাটি লাগেনি?’
‘দাঁত-কপাটি লাগবে কেন? আমি রামনাম করেছিলাম।’
‘রামনাম করেছিলি বেশ করেছিলি। কিন্তু ভয় পেয়েছিলি বলেই না। রামনাম করেছিলি?’
‘মোটেই না, মোটেই না’-অমৃত আস্ফালন করিতে লাগিল, ‘কে বলে আমি ভয় পেয়েছিলাম! ভয় পাবার ছেলে আমি নয়।’
দাশু বলিল, ‘দ্যাখ আমরা, বেশি বড়াই করিাসনি। তুই এখন জঙ্গলে যেতে পারিস?’
‘কোন পারব না’ অমৃত ঈষৎ শঙ্কিতভাবে জঙ্গলের দিকে তাকাইল। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া চাঁদের আলো ফুটিয়াছে, জঙ্গলের গাছগুলা ঘনকৃষ্ণ ছায়া রচনা করিয়াছে; অমৃত একটু মুড়ি দিয়া বলিল, ইচ্ছে করলেই যেতে পারি, কিন্তু বাব কেন? এখন তো আর বাছুর হারায়নি।’
গোপাল বলিল, ‘বাছুর না হয় হারায়নি। কিন্তু তুই গুল মারছিস কিনা বুঝব কি করে?’
অমৃত লাফাইয়া উঠিল, ‘গুল মারছি! আমি গুল মারছি! দ্যাখ গোপালা, তুই আমাকে চিনিস না—’
‘বেশ তো, চিনিয়ে দে। যা দেখি একলা জঙ্গলের মধ্যে। তবে বুঝব তুই বাহাদুর।’
অমৃত আর পারিল না, সদৰ্পে বলিল, ‘যাচ্ছি—এক্ষুনি যাচ্ছি। আমি কি ভয় করি নাকি?’ সে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াইল।
পটল তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘শোন, এই খড়ি নে। বেশি দূর তোকে যেতে হবে না, সদানন্দদার বাড়ির পিছনে যে বড় শিমুলগাছটা আছে তার গায়ে খড়ি দিয়ে ঢারা মেরে আসবি। তবে বুঝব তুই সত্যি গিয়েছিলি।’
খড়ি লইয়া ঈষৎ কম্পিত্যকণ্ঠে অমৃত বলিল, ‘তোরা এখানে থাকিবি তো?’
‘থাকব।’
অমৃত জঙ্গলের দিকে পা বাড়াইল। যতাই অগ্রসর হইল ততাই তাহার গতিবেগ হ্রাস হইতে লাগিল। তবু শেষ পর্যন্ত সে সদানন্দ সুরের বাড়ির আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল।
মাঠে উপবিষ্ট ছোকরার দল পাণ্ডুর জ্যোৎসার ভিতর দিয়া নীরবে জঙ্গলের দিকে চাহিয়া রহিল। একজন বিড়ি ধরাইল। একজন হাসিল, ‘আমরা হয়তো সদানন্দদার বাড়ির পাশে ঘাপটি মেরে বসে আছে।’
কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল। সকলের দৃষ্টি জঙ্গলের দিকে।
হঠাৎ জঙ্গল হইতে চড়াৎ করিয়া একটা শব্দ আসিল। শুকনো গাছের ডাল ভাঙ্গিলে যেরূপ শব্দ হয়। অনেকটা সেইরূপ। সকলে চকিত হইয়া পরস্পরের পানে চাহিল।
আরও কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল। কিন্তু অমৃত ফিরিয়া আসিল না। অমৃত যেখানে গিয়াছে, ছোকরাদের দল হইতে সেই শিমুলগাছ বড়জোর পঞ্চাশ-ষাট গজ। তবে সে ফিরিতে এত দেরি করিতেছে কেন!
আরও তিন-চার মিনিট অপেক্ষা করিবার পর পটল উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘চল দেখি গিয়ে। এত দেরি করছে কেন অম্রা!