অমৃতের মৃত্যু

বিশু মল্লিক সেদিন বোধহয় সদানন্দ সুরের বুবি-ট্র্যাপ পেতে ফিরে যাচ্ছিল। দু’জনেই দু’জনকে চেনে; অমৃত চাকরির জন্য বিশু মল্লিকের কাছে দরবার করছিল। বিশু মল্লিক দেখল‌, এর পর যখন বুবি-ট্র্যাপ ফাটবে তখন অমৃত সাক্ষী দেবে যে‌, সে বিশু মল্লিককে রাত্তিরে সদানন্দ সুরের বাড়ির পিছনে দেখেছে; হয়তো বিশু মল্লিক যখন সদানন্দ সুরের পাঁচিল টপকে বেরুচ্ছিল তখন দেখেছে। অতএব অমৃতের বেঁচে থাকা নিরাপদ নয়। বিশু মল্লিকের কাছে অটোম্যাটিক পিস্তল ছিল‌, সে অমৃতকে খুন করে ঘোড়ার পিঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি যখন প্রথম অকুস্থলে এসে তদন্ত আরম্ভ করলাম তখন সবচেয়ে আশ্চর্য মনে হল-ঘোড়া। অমৃত ঘোড়া-ভূত দেখেছিল‌, আমি দেখলাম জলজ্যান্ত ঘোড়ার খুরের দাগ। একটা ঘোড়া এই মামলার সঙ্গে জড়িত আছে। তখনও আমরা আসামীকে চিনি না‌, কিন্তু সে যেই হোক‌, ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে আসে। কেন?

ঘোড়ায় চড়ে শীগগির যাতায়াত করা যায়‌, কিন্তু আবার সহজেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যে-লোক দুষ্কার্য করতে বেরিয়েছে সে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় না; তবে এ-ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে আসে কেন? নিশ্চয় কোনও বিশেষ সুবিধে আছে। কী সুবিধে? সদানন্দ সুরের পাঁচল টপকানো? ঘোড়ার পিঠ থেকে পাঁচিল টপকানোর সুবিধে হয়‌, ওদিকে নামবার জন্যে পেয়ারাগাছ আছে। কিন্তু শুধু কি এই? না‌, অন্য কিছুও আছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম কাল রাত্রে। কিন্তু সে পরের কথা।

যথাসময়ে সদানন্দ সুর ফিরে এলেন। তোরঙ্গটা তিনি ফিরিয়ে আনেননি‌, বোধহয় ইচ্ছে ছিল বাড়িতে দুদিন বিশ্রাম করে ভগিনীপতির বাসা থেকে তোরঙ্গ নিয়ে আসবেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা! পূর্ণ হল না। নিজের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে প্রায় আমাদের চোখের সামনে তিনি মারা গেলেন।

সদানন্দ সুরের মৃত্যুর পর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। আমি যাকে ধরতে এসেছি সেই মেরেছে অমৃত আর সদানন্দ সুরকে। যারা আগ্নেয়াস্ত্র কেনে তারা বাইরের লোক‌, হত্যাকারী বাইরের লোক নয়; অমৃত আর সদানন্দ সুরের চেনা লোক। অমৃত তাকে দেখে ফেলেছিল এবং সদানন্দ সুর তাকে দোহন করতে শুরু করেছিল। কেবল দুটো কথা তখনও অজ্ঞাত ছিল-লোকটা কে? এবং কালো ঘোড়ায় চড়ে আসে কেন?

অমৃত বলেছিল‌, কালো ঘোড়া-ভূত‌, নাক দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। সবটাই তার উত্তপ্ত কল্পনা হতে পারে। আবার খানিকটা সত্যি হতে পারে। সুতরাং কালো ঘোড়ার খোঁজ নেওয়া দরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল সান্তালগোলায় কেবল একটি কালো ঘোড়া আছে‌, তার মালিক বদ্রিদাস মাড়োয়ারী। তবে কি বদ্রিদাস-ই আমার আসামী? বদ্রিদাস লোকটি পাঁকাল মাছের মত পিছল; তিনি ধান-চালে প্রচুর কাঁকর মেশাতে পারেন‌, স্বজ্জাতির প্রতি তাঁর অসীম পক্ষপাত থাকতে পারে; কিন্তু তিনি দু-দুটো মানুষকে খুন করতে পারেন এত সাহস নেই। তাছাড়া তাঁকে ঘোড়সওয়ার রূপে কল্পনা করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

আমি বেনামী চিঠি পাঠানোর ফলে একটা কাজ হয়েছিল‌, সন্দেহভাজনদের দল থেকে জনকতক লোককে বাদ দেওয়া গিয়েছিল। যমুনাদাস গঙ্গারাম বেনামী চিঠি পুলিসকে দেখিয়েছিল‌, সুতরাং সে নয়। নফর কুণ্ডুর ওপর প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল‌, কিন্তু দেখা গেল তার ঘোড়া নেই। পরের ঘোড়া ধার করে কেউ খুন করতে যায় না। প্রাণকেষ্ট পালকে অবশ্য আমি গোড়া থেকে বাদ দিয়েছিলাম। ট্রলিতে চড়ে বাঘমারি গ্রামের কাছাকাছি যাওয়া যায় বটে‌, কিন্তু ট্রলিতে কুলি থাকে‌, তাদের চোখ এড়িয়ে খুন করার সুবিধে নেই। আমার শুধু জানবার কৌতুহল ছিল‌, সদানন্দ সুরের ট্রাঙ্কে কী আছে।

যাহোক, সন্দেহভাজনের দলকে ছাঁটাই করে মাত্র তিনজন দাঁড়াল—বদ্রিদাস মাড়োয়ারী, বিশু মল্লিক। আর সুখময় দারোগা। সুখময় দারোগাকে বাদ দিতে পারিনি; তার একটা ঘোড়া আছে‌, যদিও সেটা কালো নয়। এবং তার পক্ষে এইজাতীয় কারবার চালানো যত সহজ এমন আর কারুর পক্ষে নয়। প্রদীপের নিচেই অন্ধকার বেশি।

অবশ্যি যখন জানতে পারলাম বিশু মল্লিক একসময় জকি ছিল‌, তখন সব সন্দেহই তার ওপর গিয়ে পড়ল। উপরন্তু জানা গেল‌, বিশু মল্লিক সদানন্দ সুরকে পাঁচশো টাকা ধার দিয়েছে। আসলে ওটা ধার নয়-ঘুষ। সদানন্দ সুরের মত নিঃস্ব লোককে কোনও ব্যবসাদার শুধু হাতে ধরা দেবে না।

আমি বিশু মল্লিকের জন্যে টোপ ফেললাম‌, আমার মনের প্রাণের কথা সব তাকে বলে ফেললাম। জঙ্গলে যে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখা সম্ভব এ-চিন্তা আমার গোড়া থেকেই ছিল। আমি ভেবেছিলাম শিমুলগাছের কাছাকাছি কোথাও মাটিতে পোঁতা আছে। বিশু মল্লিক। যখন শুনল আমরা জঙ্গল খানাতল্লাশ করবার মতলব করেছি‌, তখন সে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। অস্ত্রগুলো অবশ্য খুবই যত্ন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে; কিন্তু বলা যায় না‌, পুলিস খুঁজে বার করতে পারে। তখন বিশু মল্লিককে অবশ্য ধরা যাবে না‌, কিন্তু অনেক টাকার মাল বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। বিশু মল্লিক লোভে পড়ে গেল।

কাল বিকেলে আমি যখন রামডিহি যাবার জন্যে ট্রেনে চড়লাম। তখন বিশু মল্লিক এসে দেখে গেল। আমি সত্যি যাচ্ছি। কিনা। আমার অবশ্য রামডিহি পৰ্যন্ত যাবার প্ল্যান ছিল না‌, স্থির করেছিলাম। পরের স্টেশনে নেমে বাঘমারিতে ফিরে আসব। কিন্তু দৈব অনুকুল‌, ঠিক বাঘমারি গ্রামের গায়ে ট্রেন থেমে গেল।

গ্রামে গিয়ে পটল‌, দাশু আর গোপালকে যোগাড় করলাম; তাদের নিয়ে জঙ্গলে গেলাম। সারা জঙ্গল তল্লাশ করা অসম্ভব; কিন্তু সদানন্দ সুরের পাঁচিলের পাশে যেখানে ঘোড়ার খুরের দাগ পাওয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে শিমুলগাছের গোড়া পর্যন্ত খুঁজে দেখলাম‌, যদি কোথাও সদ্য-খোঁড়া মাটি দেখতে পাই। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না।

0 Shares