এখন কি করা যায়! সূৰ্য্যস্তের বেশি দেরি নেই। জঙ্গলে বসে সিগারেট টানতে টানতে মতলব ঠিক করে নিলাম। পটলদের বললাম, চলো, সান্তালগোলার দিকে যাওয়া যাক।’
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সান্তালগোলার কিনারায় পৌঁছলাম। এখানে জঙ্গল প্রায় দেড়শো গজ চওড়া; একপ্রান্তে স্টেশন, অন্যপ্ৰান্তে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক, মাঝামাঝি বিশু মল্লিকের মিল। মিল-এর এটা পিছন দিক, কাঁটা-তারের বেড়ায় ছোট খিড়কির ফটক আছে। আমি পটলদের আমার প্ল্যান বুঝিয়ে দিলাম। তারা জঙ্গলের কিনারায় সম-ব্যবধানে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকবে। এবং লক্ষ্য করবে ঘোড়ায় চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে কেউ জঙ্গলে ঢোকে। কিনা। লোকটাকে চেনবার চেষ্টা করবে, কিন্তু কোনও অবস্থাতেই ধরবার চেষ্টা করবে না।
পটল উঠল বিশু মল্লিকের মিল-এর সরাসরি একটা গাছে দাশু গেল স্টেশনের দিকে, আর গোপাল ব্যাঙ্কের দিকে। আকাশে আজও চাঁদ আছে; রাত হলেও, এদের চোখ এড়িয়ে কেউ জঙ্গলে ঢুকতে পারবে না।
ওদের গাছে তুলে দিয়ে আমি ফিরে চললাম। শিমুলগাছের কাছে। ওই গাছটা আমার মনে ঘোর সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিল। অমৃতের মৃত্যু হয় ঐ গাছের তলায়। এ-রহস্যের চাবিকাঠি যদি জঙ্গলের মধ্যে থাকে। তবে নিশ্চয় ঐ শিমুলগাছের কাছাকাছি কোথাও আছে।
যখন শিমুলতলায় ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে, চাঁদের আলো ফুটেছে। শিমুলগাছ থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে একটা ঝাঁকড়া গোছের গাছ ছিল, আমি তাতে উঠে পড়লাম। এইখানে বসে বাঘ-শিকারীর মত অপেক্ষা করব। আমার সঙ্গে অস্ত্র নেই, আমি এসেছি শুধু ব্যাঘ্র-মশাইকে দেখতে। তিনি আসবেন কিনা জানি না, কিন্তু যদি আসেন, নটর আগেই আসবেন।
শিমুলগাছের সব পাতাই প্ৰায় ঝরে গেছে, গাছের তলায় ছায়া নেই। চাঁদ যত উচুতে উঠছে। আলো তত পরিষ্কার হচ্ছে। হঠাৎ কাছের একটা গাছ থেকে কোকিল ডেকে উঠল। বিচিত্র পরিস্থিতি। আমি বসে আছি। একটা নৃশংস নরহস্তাকে দেখব বলে, আর—কোকিল ডাকছে! আজব দুনিয়া!
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। চোখের কাছে হাত এনে ঘড়ি দেখলাম, পৌঁনে আটটা। সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে একটা আওয়াজ কানে এল, শুকনো পাতার ওপর পায়ের মচমচ শব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, ঘন ছায়ার ভিতর থেকে ধীর-মস্থর গমনে একটা ঘোড়া বেরিয়ে আসছে। কালো ঘোড়া। তার পিঠে বসে আছে কালো-পোশাক পরা একটা মানুষ। মানুষটার মুখ দেখতে পাচ্ছি। না, কিন্তু সে জাকির মত সামনে ঝুকে বসেছে আর সতর্কভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
ঘোড়াটা সোজা গিয়ে শিমুলগাছের বিরাট গুড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়াল, পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর যা দেখলাম তা একেবারে সার্কাসের খেলা। ঘোড়ার সওয়ার টপ করে ঘোড়ার পিঠে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাত বাড়িয়ে শিমুলগাছের গুড়িতে একটা ফোকরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলে। মাটি থেকে দশ হাত উঁচুতে যেখানে ডালপালা বেরিয়েছে সেখানে একটা খোপের মত ফুটো আছে। অচিন পাখির বাসা!
ঘোড়ার পিঠে আসামী কেন জঙ্গলে আসে এখন বুঝতে পারছি? অস্ত্রগুলো মাটিতে পোঁতা নেই, আছে গাছের ফোকরের মধ্যে, মাটি থেকে দশ হাত উচুতে। শিমুলগাছের গায়ে শক্ত-শক্ত মোটা মোটা কাঁটা থাকে; শিমুলগাছে মানুষ ওঠে না, এমন কি কাঠবেরালি পর্যন্ত ওঠে না। এমন নিরাপদ গুপ্তস্থান আর নেই। অবশ্য মই লাগিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু কে মই লাগবে? আর যিনি জানেন তিনি যদি মই ঘাড়ে করে জঙ্গলে আসেন তাহলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তার চেয়ে ঘোড়া ঢ়ের নিরাপদ; বিশেষত যদি জকির হাতের শিক্ষিত ঘোড়া হয়।
যাহোক, ঘোড়সওয়ারের বাঁ হাতে একটা থলি আছে; সে খোপের মধ্যে ডান হাত ঢুকিয়ে একটি একটি করে অস্ত্রগুলি বার করছে আর থলিতে রাখছে। এতক্ষণে ঘোড়সওয়ারকে চিনতে পেরেছি-বিশু মল্লিক। মুখ চিনতে না পারলেও, ঐ রোগা বেঁটে শরীর আর ধনুকের মত বাঁকা ঠ্যাং ভুল হবার নয়। আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু একটা ধোঁকা তখনও কাটেনি; বিশু মল্লিক কালো ঘোড়া পেল কোথেকে? সে ভরি ইঁশিয়ার লোক, তার যদি কালো ঘোড়া থাকত সে কখনই আমার কাছে মিথ্যেকথা বলত না। আসলে আমি যখন তাকে কালো ঘোড়া সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম তখন সে আমার প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। এ-মামলার সঙ্গে কালো ঘোড়ার যে কোনও সম্বন্ধ আছে তা সে কল্পনা করতেই পারেনি। আমি কালো ঘোড়ার রহস্য বুঝলাম কাল দুপুর-রাত্রে, বাসায় ফিরে এসে।
সে যাক, বিশু মল্লিক থলি ভরে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে নেমে বসিল, তারপর মন্দমন্থর চালে ফিরে চলল। সে জঙ্গলের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে যাবার পর আমি গাছ থেকে থেকে নোমলাম। ঘড়িতে তখন সওয়া আটটা। আমি আবার পটলদের উদ্দেশে ফিরে চললাম। আমার প্ল্যান ঠিকই ফলেছে; পুলিস কাল জঙ্গল তল্লাশ করবে, তাই আজ বিশু মল্লিক অস্ত্রগুলো জঙ্গল থেকে সরিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অস্ত্রগুলোকে সে রাখবে কোথায়? কারণ, কেবল মানুঘটাকে ধরলে চলবে না, অস্ত্রগুলোও চাই। বস্তুত, অস্ত্রগুলো না পেলে মানুষটাকে ধরে কোনও লাভ নেই।
আমি যখন জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছলাম তখনও পটলেরা গাছ থেকে নামেনি, আমাকে দেখে নেমে এল। তিনজনেই ভীষণ উত্তেজিত; তারা ঘোড়সওয়ারকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছে এবং চিনতে পেরেছে। বিশু মল্লিক তার রাইস মিল-এর খিড়কি-ফটক দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেরিয়ে এল, পটলের গাছের প্রায় পাশ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকাল। চল্লিশ মিনিট পরে আবার ফিরে ফটিক দিয়ে মিল-এ চলে গেল।
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘ঠিক দেখেছি নিজের ফটকে ঢুকেছে? অন্য কোথাও যায়নি?’