পটল বলল, ‘আজ্ঞে না, অন্য কোথাও যায়নি।’
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। অস্ত্রগুলো বিশু মল্লিক মিলেই রাখবে, অন্তত যতদিন না পুলিস জঙ্গল-তল্লাশ শেষ করে। আমি সকালবেলা তাকে বলেছিলাম মিল খানাতল্লাশ করব না, আমার কথায় সে বিশ্বাস করেছে। আমাকে বিশু মল্লিক বোধ হয় খুবই সরলপ্রকৃতির লোক বলে মনে করেছিল।
আমি তখন পটল, দাশু আর গোপালের পিঠ ঠুকে দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের জন্যে অমৃতের মৃত্যুর কিনারা করতে পারলাম। কিন্তু আজ আর বেশি কৌতুহল প্রকাশ কোরো না; কাল সকাল ন’টার সময় এসো, তখন সব জানতে পারবে। কিন্তু সাবধান, কাউকে একটি কথা বলবে না।’
তারা গ্রামে ফিরে গেল। আমি থানায় গেলাম। সুখময় দারোগার কাছে পিস্তলটা যোগাড় করে স্টেশনে গেলাম। স্টেশন থেকে কাজকর্ম সেরে যখন ফিরে এলাম তখন রাত দুপুর, তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ।
তোমাকে জাগালাম না, পিছনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি, জানালার বাইরে কয়েকটা জন্তু বসে আছে। প্রথমটা আমিও ভেবেছিলাম কালো কুকুর, তারপর লক্ষ্য করে দেখলাম, কুকুর নয়—শেয়াল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে কালো ঘোড়ার রহস্য ভেদ হয়ে গেল। বুঝতে পারলে না? অত্যন্ত সহজ, এমন কি, হাস্যকর। কেন যে কথাটা মাথায় আসেনি জানি না।—শেয়ালের গায়ের রঙ কালো নয়, পাটকিলে। অথচ আমরা দেখলাম কালো। ঘোড়াটাও কালো ছিল না, ছিল গাঢ় বাদামী রঙের; ইংরেজিতে যাকে বলে চেস্টনাট। চাঁদের আলোয় সব গাঢ় রঙই দূর থেকে কালো দেখায়। তাই অমৃত কালো ঘোড়া-ভূত দেখেছিল, আমিও কালো ঘোড়া দেখেছিলাম। এই হল কালো ঘোড়ার রহস্য। রহস্য না বলে যদি পরিহাস বলতে চাও তাতেও আপত্তি নেই।
রাত্রে খেতে বসে তুমি সস্ত্রীক প্রাণকেষ্ট পালের উপাখ্যান বললে। ওদের গলদ কোথায় বুঝতে বেশি কষ্ট হয় না। প্রাণকেষ্ট পাল নিজের কাজে বেশ দক্ষ, কিন্তু ঘরে জারিজুরি চলে না, স্ত্রীর কাছে কেঁছো। সদানন্দ সুর বোনের কাছে তোরঙ্গ রেখে গিয়েছিলেন ঠিকই। তোরঙ্গ গোড়ায় ভাঙ্গা হয়নি; কিন্তু যখন তাঁর মৃত্যু-সংবাদ এল, তখন ভগিনী সুশীলা আর দ্বিধা করলেন না, তেরঙ্গের তালা ভাঙলেন এবং যা পেলেন আত্মসাৎ করলেন। হয়তো দাদার বিষয়সম্পত্তি সবই তিনি শেষ পর্যন্ত পাবেন, কিন্তু আইনের কথা কিছু বলা যায় না। হাতে যা পাওয়া গেছে তা হজম করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই হচ্ছে ভগিনী সুশীলার মনস্তত্ত্ব। প্রাণকেষ্ট পাল কিন্তু পুরুষমানুষ, হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান আছে, তাই তোমাকে দেখে তিনি বেজায় নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন।–
তারপর আর কি? এবার বেদব্যাসের বিশ্রাম। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে বিশু মল্লিকের মত আরও কত মহাজন নীরবে তপস্যা করছেন কে তার খবর রাখে।’
ব্যোমকেশ প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া পাশ ফিরিল; বলিল, ‘জাগি পোহাল বিভাবরী। এইবেলা একটুকু ঘুমিয়ে নাও, আজ রাত্রেই কলকাতা ফিরব। হে হে।’
(সমাপ্ত)