অমৃতের মৃত্যু

সকলে দল বাঁধিয়া যে-পথে অমৃত গিয়াছিল সেই পথে চলিল। একজন রহস্য করিয়া বলিল‌, ‘আমরা ঘোড়া-ভূতের পিঠে চড়ে পালাল নাকি?’

আমরা কিন্তু পালায় নাই। সদানন্দ সুরের বাড়ির খিড়কি হইতে বিশ-পাঁচশ গজ দূরে শিমুলগাছ। সেখানে জ্যোৎস্না-বিদ্ধ অন্ধকারে সাদা রঙের কি একটা পড়িয়া আছে। সকলে কাছে গিয়া দেখিল-অমৃত।

একজন দেশলাই জ্বালিল। অমৃত চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে‌, তাহার বুকের জামা রক্তে ভিজিয়া উঠিয়াছে।

অমৃত ভূতের ভয়ে মরে নাই‌, বন্দুকের গুলিতে তাহার মৃত্যু হইয়াছে।

ব্যোমকেশ আমাকে লইয়া সান্তালগোলায় আসিয়াছিল একটা সরকারী তদন্ত উপলক্ষে। সরকারের বেতনভুক পুলিস-কর্মচারীরা ব্যোমকেশকে মেহের চোখে দেখেন না বটে‌, কিন্তু মন্ত্রিমহলে তাহার খাতির আছে। পুলিসের জবাব দেওয়া কেস মাঝে মাঝে তাহার ঘাড়ে আসিয়া পড়ে।

গত মহাযুদ্ধের সময় অনেক বিদেশী সৈন্য আসিয়া এদেশের নানা স্থানে ঘাঁটি গাড়িয়া বসিয়াছিল; তারপর যুদ্ধের শেষে বিদেশীরা চলিয়া গেল‌, দেশে স্বদেশী শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হইল। স্বাধীনতার রক্ত-স্নান শেষ করিয়া দেশ যখন মাথা তুলিল তখন দেখিল হ্রদের উপরিভস্ট শান্ত হইয়াছে বটে‌, কিন্তু তলদেশে হিংসুক নক্বকুল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। বিদেশী সৈন্যদলের ফেলিয়া-যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে এই নক্বকুলের নখদন্ত। রেলের দুর্ঘটনা‌, আকস্মিক বোমা বিস্ফোরণ‌, সশস্ত্র ডাকাতি-নূতন শাসনতন্ত্রকে উদব্যস্ত করিয়া তুলিল।

পুলিস তদন্তে দু’চারজন দুৰ্বত্ত ধরা পড়িলেও‌, বোমা পিস্তল প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র কোথা হইতে সরবরাহ হইতেছে তাহার হদিস মিলিল না। বিদেশী সিপাহীরা যেখানে ঘাঁটি‌, গাড়িয়াছিল‌, অস্ত্রগুলি যে তাহার কাছেপিঠেই সঞ্চিত হইয়াছে তাহা অনুমান করা শক্ত নয়; কিন্তু আসল সমস্যা দাঁড়াইয়াছিল অস্ত্র-সরবরাহকারী লোকগুলাকে ধরা। যাহারা অবৈধ আগ্নেয়াস্ক্রের কালাবাজার চালাইতেছে তাহাদের ধরিতে না পারিলে এ উৎপাতের মুলোচ্ছেদ হইবে না।

সরকারী দপ্তরের সহিত পরামর্শ করিয়া ব্যোমকেশ প্রথমে সন্তালগোলায় আসিয়াছে। স্থানটি ছোট‌, কোন অবস্থাতেই তাহাকে শহর বলা চলে না। স্টেশনের কাছে রোল-কর্মচারীদের একসারি কোয়ার্টার। একটা পাকা রাস্তা স্টেশনকে স্পর্শ করিয়া দুই দিকে মোড় ঘুরিয়া গিয়াছে এবং কুক্তি পাঁচশ বিঘা জমিকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াছে; এই স্থানটুকুর মধ্যে কয়েকটা বড় বড় আড়ত‌, পুলিস থানা‌, পোস্ট-অফিস‌, কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক‌, সরকারী বিশ্রান্তি গৃহ ইত্যাদি আছে। যে দু’টি চাল-কলের উল্লেখ পূর্বে করিয়াছি সে দু’টি এই রাস্তা-ঘেরা স্থানের দুই প্রান্তে অবস্থিত। স্থানীয়–লোক অধিকাংশ বাঙালী হইলেও‌, মাড়োয়ারী ও হিন্দুস্থানী যথেষ্ট আছে।

আমরা সরকারী বিশ্রান্তিগুহে আড্ডা গাড়িয়াছিলাম। ব্যোমকেশের এখানে আত্মপরিচয় দিবার ইচ্ছা ছিল না‌, এ ধরনের তদন্তে যতটা প্রচ্ছন্ন থাকা যায় ততাই সুবিধা; কিন্তু আসিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশের পরিচয় ও আগমনের উদ্দেশ্য কাহারও অবিদিত নাই। স্থানীয় পুলিসের দারোগ’ সুখময় সামন্ত পুলিস বিভাগ হইতে ব্যোমকেশ সম্বন্ধে পূর্ব হইতেই ওয়াকিবহাল ছিলেন‌, তাঁহার কৃপায় ব্যোমকেশের খ্যাতি দিকে দিকে ব্যাপ্ত হইয়াছে।

দারোগা সুখময়বাবুর মুখ ভারি মিষ্ট‌, কিন্তু মস্তিষ্কটি দুষ্টবুদ্ধিতে ভরা। তিনি প্রকাশ্যে ব্যোমকেশকে সাহায্য করিতেছিলেন এবং অপ্রকাশ্যে যত ভাবে সম্ভব বাগড়া দিতেছিলেন পুলিস যেখানে ব্যর্থ হইয়াছে‌, একজন বাহিরের লোক আসিয়া সেখানে কৃতকার্য হইবে‌, ইহা বোধ হয় তাঁহার মনঃপুত হয় নাই।

যাহোক‌, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও ব্যোমকেশ কাজ আরম্ভ করিল। পরিচয় গোপন রাখা সম্ভব নয়। দেখিয়া প্রকাশ্যভাবেই অনুসন্ধান শুরু করিল। খোলাখুলি থানায় গিয়া দারোগা সুখময়বাবুর নিকট হইতে স্থানীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তির নামের তালিকা সংগ্রহ করিল। স্টেশনে গিয়া মাস্টার‌, মালবাবু্‌, টিকিট-বাবু্‌, চেকার প্রভৃতির সহিত ভাব জমাইল; কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে গিয়া ম্যানেজারের নিকট হইতে স্থানীয় বিত্তবান ব্যক্তিদের খোঁজখবর লইল। সকলেই জানিতে পারিয়াছিল ব্যোমকেশ কি জন্য আসিয়াছে‌, তাই সকলে সহযোগিতা করিলেও বিশেষ কোনও ফল হইল না।

চার পাঁচ দিন বৃথা ঘোরাঘুরির পর ব্যোমকেশ এক মতলব বাহির করিল। স্থানীয় যে-কয়জন বর্ধিষ্ণু লোককে সন্দেহ করা যাইতে পারে তাহাদের বেনামী চিঠি লিখিল। চিঠির মর্ম : আমি তোমার গোপন কার্যকলাপ জানিতে পারিয়াছি‌, শীঘ্রই দেখা হইবে। —চিঠিগুলি আমি দুই-তিন স্টেশন দূরে জংশনে গিয়া ডাকে দিয়া আসিলাম।

চার ফেলিয়া বসিয়া আছি‌, কিন্তু মাছের দেখা নাই। এইভাবে আরও দুই তিন দিন কাটিয়া গেল। নিষ্কমার মতো দিন রাত্রে ঘুমাইয়া ও সকাল সন্ধ্যা ভ্বমণ করিয়া স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হইতে লাগিল। কিন্তু কাজের সুরাহা হইল না।

তারপর একদিন সকালবেলা বাঘমারি গ্রাম হইতে তিনটি ছেলে আসিয়া উপস্থিত হইল।

বেলা আন্দাজ আটটার সময় গরম জিলাপী সহযোগে গরম দুদ্ধ সেবন করিয়া অভ্যন্তরভাগে বেশ একটি তৃপ্তিকর পরিপূর্ণতা অনুভব করিতেছি‌, এমন সময় দ্বারের কাছে কয়েকটি মুণ্ড উঁকিঝুঁকি মারিতেছে দেখিয়া ব্যোমকেশ বাহিরে আসিল‌, ‘কি চাই?’

বিশ্রান্তিগুহে পাশাপাশি দু’টি ঘর‌, সামনে ঢাকা বারান্দা। তিনটি যুবক বারান্দায় উঠিয়া ইতস্তত করিতেছিল‌, ব্যোমকেশকে দেখিয়া যুগপৎ দস্তবিকাশ করিল। একজন সসন্ত্রমে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনিই ব্যোমকেশবাবু?’

0 Shares