অমৃতের মৃত্যু

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ।’

যুবকদের দন্তবিকাশ কর্ণচুম্বী হইয়া উঠিল। একজন বলিল‌, ‘আমরা বাঘমারি গ্রাম থেকে আসছি।’

‘বাঘমারি গ্রাম! সে কোথায়?’

‘আজ্ঞে‌, বেশি দূর নয়‌, এখান থেকে মাইলখানেক।’

‘আসুন’—বলিয়া ব্যোমকেশ তাহাদের ঘরে লইয়া আসিল। বিশ্রান্তিগুহের বাঁধা বরাদ্দ আসবাব-একটি চেয়ার‌, একটি টেবিল‌, একটি আরাম-কেদারা‌, দু’টি খাট‌, মেঝেয় নারিকেল-ছোবড়ার চাটাই পাতা। যুবকেরা দু’জন মেঝোয় বসিল‌, একজন টেবিলে উঠিয়া বসিল। ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় অর্ধশয়ান হইয়া বলিল‌, ‘কী ব্যাপার বলুন দেখি?

যে ছোকরা অগ্রণী হইয়া কথা বলিতেছিল তাহার নাম পটল। অন্য দু’জনের নাম দাশু ও গোপাল। পটল বলিল‌, ‘আপনি শোনেননি! আমাদের গ্রামে একটা ভীষণ হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে।’

‘বলেন কি! কবে? ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় উঠিয়া বসিল।

দাশু ও গোপাল একসঙ্গে বলিয়া উঠিল‌, ‘পরশু সন্ধ্যের পর।’

পটল বলিল‌, ‘পুলিসে তক্ষুনি খবর দেওয়া হয়েছিল। কাল সকালবেলা নাটার সময় দারোগা সুখময় সামন্ত গিয়েছিল। লাশ নিয়ে চলে এসেছিল‌, তারপর আর কোনও খবর নেই। আজ আমরা আপনার কাছে আসবার আগে থানায় গিয়েছিলাম‌, সুখময় দারোগা আমাদের হাঁকিয়ে দিলে। লাশ নাকি সদরে পাঠানো হয়েছে‌, হাসপাতালে চেরা-ফাঁড়া হবে। আপনি এসব কিছুই জানেন না? তবে যে শুনেছিলাম। আপনি পুলিসকে সাহায্য করবার জন্য এখানে এসেছেন।’

ব্যোমকেশ শুষ্কস্বরে বলিল‌, ‘দারোগাবাবু বোধ হয় এ খবর আমাকে দেওয়া দরকার মনে করেননি। সে যাক। কে কাকে খুন করেছে? কী দিয়ে খুন করেছে?’

পটল বলিল‌, ‘বন্দুক দিয়ে। খুন হয়েছে আমাদের এক বন্ধু—অমৃত। কে খুন করেছে তা কেউ জানে না। ব্যোমকেশবাবু্‌, আমরার মৃত্যুর জন্য আমরাও খানিকটা দায়ী‌, ঠাট্টা-তামাশা করতে গিয়ে এই সর্বনাশ হয়েছে। তাই আমরা আপনার কাছে এসেছি। সুখময় দারোগার দ্বারা কিছু হবে না‌, আপনি দয়া করে খুঁজে বার করুন কে খুন করেছে। আমরা আপনার কাছে চিরঋণী। হয়ে থাকব।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বন্দুক দিয়ে খুন হয়েছে। আশ্চর্য!—সব কথা খুলে বলুন।’

অতঃপর পটল‌, দাশু ও গোপাল মিলিয়া কখনও একসঙ্গে কখনও পর্যায়ক্রমে যে কাহিনী বলিল তাহা পূর্বে বিবৃত হইয়াছে। অমৃতের মৃত্যুতে তাহারা খুব কাতর হইয়াছে এমন মনে হইল না‌, কিন্তু অমৃতের রহস্যময় মৃত্যু তাঁহাদের উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছে। এবং ব্যোমকেশকে হাতের কাছে পাইয়া এই উত্তেজনা নাটকীয় রূপ ধারণ করিয়াছে।

অমৃতের মৃত্যু-ব্বিরণ শেষ হইতে আন্দাজ দুঘণ্টা লাগিল; ব্যোমকেশ মাঝে মাঝে প্রশ্ন করিয়া অস্পষ্ট স্থান পরিষ্কার করিয়া লইল। শেষে বলিল‌, ‘ঘটনা রহস্যময় বটে‌, তার ওপর বন্দুক।–কিন্তু শুধু গল্প শুনলে কাজ হবে না‌, জায়গাটা দেখতে হবে।’

তিনজনেই উৎসাহিত হইয়া উঠিল। পটল বলিল‌, ‘বেশ তো‌, এখুনি চলুন না‌, ব্যোমকেশবাবু। আপনি আমাদের গ্রামে যাবেন সে তো ভাগ্যের কথা।’

ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘এ-বেলা থাক। দুদিন যখন কেটে গেছে তখন একবেলায় বিশেষ ক্ষতি হবে না। আমরা ও-বেলা পাঁচটা নাগাদ যাব।’

‘বেশ‌, আমরা এসে আপনাকে নিয়ে যাব।’

তাহারা চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরে দারোগা সুখময়বাবু আসিলেন। চেয়ারে নিজের সুবিপুল বপুখানি ঠাসিয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘বাঘমারির ছোঁড়াগুলো এসেছিল তো? আমার কাছেও গিয়েছিল। বাঙালীর ছেলে‌, একটা হুজুগ পেয়েছে‌, আর কি রক্ষে আছে! আপনি ওদের আমল দেবেন না মশাই‌, আপনার প্রাণ অতিষ্ঠা করে তুলবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না না‌, আমল দেব কেন? আপনি তো ওদের আগে থাকতেই চেনেন‌, কেমন ছেলে ওরা?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘পাড়াগাঁয়ের বকাটে নিষ্কমা ছেলে আর কি। বাপের দুবিঘে ধান-জমি আছে‌, কি তিনটে নারকেল গাছ আছে‌, বাস‌, ঘরে বসে-বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যে ছেলেটা মারা গেছে সেও তো ওদেরই দলেরই ছেলে।’

‘হ্যাঁ‌, সে ছিল আবার এককাটি বাড়া। মামার ভাতে ছিল‌, বিকামি করে বেড়াতো।’

‘বন্দুকের গুলিতে মরেছে শুনলাম।’

‘তাই মনে হয়‌, তবে তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যায় না।’

‘হুঁ। কে মেরেছে কিছু সন্দেহ করেন?’

‘কি করে সন্দেহ করব বলুন দেখি? কেউ কিছু দেখেনি‌, সবাই একজোট হয়ে মাঠে আড্ডা দিচ্ছিল। তবে একটা ব্যাপারের জন্যে একজনের ওপর সন্দেহ হচ্ছে। সেদিন সকালবেলা অমৃত নাদুর বেঁকে অপমান করেছিল। নাদু একরোখা গোঁয়ার মানুষ‌, লাঠি নিয়ে অমৃতকে মারতে ছুটেছিল। সন্ধ্যেবেলা মাঠের আড্ডাতেও সে ছিল না। তাকে একবার থানায় আনিয়ে ভালো করে নেড়ে-চেড়ে দেখতে হবে। —কিন্তু এসব বাজে কথা এখন থাক। একটা জরুরী খবর আপনাকে দিতে এলাম।’ সহসা গলা খাটো করিয়া বলিলেন‌, ‘যমুনাদাস গঙ্গারামের নাম জানেন তো‌, এখানকার মস্ত।বড় আড়তদার। সে একটা বেনামী চিঠি পেয়েছে।’

ব্যোমকেশ গাঢ় ঔৎসুক্য দেখাইয়া বলিল‌, ‘বেনামী চিঠি! কি আছে তাতে?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘যমুনাদাস চুপিচুপি আমাকে চিঠি দেখিয়ে গেছে। খামের চিঠি‌, তাতে স্রেফ লেখা আছে; আমি সব জানতে পেরেছি‌, শীগগিরই দেখা হবে।’

‘তাই নাকি! তাহলে তো যমুনাদাসের ওপর নজর রাখতে হয়।’

‘সে-কথা আর বলতে! আমি একজন লোক লাগিয়ে দিয়েছি। যমুনাদাসের পেছনে। সে অষ্টপ্রহর যমুনাদাসের ওপর নজর রেখেছে।’

‘ভালো‌, ভালো! আপনি পাকা লোক‌, ঠিক কাজই করেছেন। এবার হয়তো একটা সুরাহা হবে।’

সুখময়বাবুর মুখে একটু বিনীত আত্মপ্রসন্নতা খেলিয়া গেল‌, ‘হে-হে—এই কাজ করে চুল পেকে গেল‌, ব্যোমকেশবাবু। তা সে যাক। এখন আপনার কি খবর বলুন। কিছু পেলেন?’

0 Shares