অমৃতের মৃত্যু

ব্যোমকেশ হতাশ স্বরে বলিল‌, ‘কৈ আর পেলাম! যতদূর চাই‌, নাই নাই সে-পথিক নাই।’

সুখময়বাবু উদ্ধৃতিটা ধরিতে পারিলেন না‌, কিন্তু যেন বুঝিয়াছেন এমনিভাবে হো-হে করিলেন। তিনি চেয়ারে একেবারে জাম হইয়া বসিয়াছিলেন‌, এখন টানা-হেঁচড়া করিয়া নিজেকে চেয়ারের বাহুমুক্ত করিলেন। বলিলেন‌, ‘আজ উঠি‌, থানায় অনেক কাজ পড়ে আছে।’

ব্যোমকেশও উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘ভালো কথা‌, অমৃতের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পেয়েছেন নাকি?’ সুখময়বাবু একটু ভ্রূ তুলিয়া বলিলেন‌, ‘এখনও পাইনি। কাল পরশু পাব বোধ হয়। কেন বলুন দেখি?

‘পেলে এবার আমাকে দেখাবেন।’

সুখময়বাবু একটু গভীর হইয়া বলিলেন‌, ‘দেখতে চান‌, দেখাব। কিন্তু ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি রুই-কাতলা ধরতে এসেছেন‌, আপনি যদি চুনোপুটির দিকে নজর দেন তাহলে আমরা বাঁচি কি করে?’

‘না না‌, নজর দিইনি। নিতান্তাই অহেতুক কৌতুহল। কথায় বলে-নেই কাজ তো খই ভাজ।’

সুখময়বাবুর মুখে আবার হাসি ফুটিল‌, তিনি দ্বারের দিকে যাইতে যাইতে প্রথম আমাকে লক্ষ্য করিলেন; বলিলেন‌, ‘এই যে অজিতবাবু্‌, কেমন আছেন? গল্প-টল্প লেখা হচ্ছে? আপনার আজগুবি গল্পগুলো পড়তে মন্দ লাগে না-হো-হে। তবে রবার্ট ব্লেকের মতো নয়। আচ্ছা‌, আসি।’

তিনি শ্রুতিবহির্ভূত হইয়া গেলে ব্যোমকেশ আমার দিকে ফিরিয়া চোখ টিপিল; বলিল‌, ‘হে হে’

বৈকালবেলা ছেলেরা আসিয়া আমাদের গ্রামে লইয়া গেল। রেল-লাইনের ধার দিয়া যখন গ্রামের নিকট উপস্থিত হইলাম তখন গ্রামের সমস্ত পুরুষ অধিবাসী আমাদের অভ্যর্থনা করিবার জন্য লাইনের ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে‌, ছেলে-বুড়া কেহ বাদ যায় নাই। সকলের চোখেবিস্ফারিত কৌতুহল। ব্যোমকেশ বক্সী কীদৃশ জীব তাহার স্বচক্ষে দেখিতে চায়।

মিছিল করিয়া আমরা গ্রামে প্রবেশ করিলাম। পটল অগ্রবর্তী হইয়া আমাদের একটি বাড়িতে লইয়া গেল। কাঁচা-পাকা বাড়ি‌, সামনের দিকে দু’টি পাকা-ঘর‌, পিছনে খড়ের চাল। মৃত অমৃতের মামার বাড়ি।

অমৃতের মামা বলরামবাবু বাড়ির সামনের চাতালে টেবিল-চেয়ার পাতিয়া চায়ের আয়োজন করিয়াছিলেন‌, জোড়হস্তে আমাদের সংবর্ধনা করিলেন। লোকটিকে ভালোমানুষ বলিয়া মনে হয়‌, কথাবলার ভঙ্গীতে সঙ্কুচিত জড়তা। তিনি ভাগিনার মৃত্যুতে খুব বেশি শোকাভিভূত না হইলেও একটু যেন দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছেন।

চায়ের সরঞ্জাম দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এসব আবার কেন?’

বলরামবাবু অপ্রতিভভাবে জড়াইয়া জড়াইয়া বলিলেন‌, ‘একটু চা-সামান্য—’

পটল বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আমাদের গ্রামের পায়ের ধুলো দিয়েছেন আমাদের ভাগ্যি। চা খেতেই হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, সে পরে হবে‌, আগে জঙ্গলটা দেখে আসি।’

‘চলুন।’

পটল আবার আমাদের লইয়া চলিল। আরও কয়েকজন ছোকরা সঙ্গে চলিল। বলরামবাবুর বাড়ির সম্মুখ দিয়া যে কাঁচা-রাস্তাটি গিয়াছে তাঁহাই গ্রামের প্রধান রাস্তা। এই রাস্তা একটি অসমতল শিলাকঙ্করপূর্ণ আগাছাভিরা মাঠের কিনারায় আসিয়া শেষ হইয়াছে। মাঠের পরপারে একটিমাত্র পাকা বাড়ি; সদানন্দ সুরের বাড়ি। তাহার পিছনে জঙ্গলের গাছপালা। আমরা মাঠে অবতরণ করিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এই মাঠে বসে তোমরা সেদিন গল্প করছিলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ঠিক কোন জায়গায় বসেছিলে?’

‘এই যে–’ আরও কিছুদূর গিয়া পটল দেখাইয়া বলিল‌, ‘এইখানে।’

স্থানটি অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন‌, আগাছা নাই। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখান থেকে অমৃত যো-পথে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। সেই পথে নিয়ে চল।’

‘আসুন।’

সদানন্দ সুরের দরজায় তালা ঝুলিতেছে‌, জানালাগুলি বন্ধ। আমরা বাড়ির পাশ দিয়া পিছ= দিকে চলিলাম। পিছনে পাঁচল-ঘেরা উঠান‌, পাঁচিল প্ৰায় এক মানুষ উঁচু‌, তাহার গায়ে একটি খিড়কি-দরজা। জঙ্গলের গাছপালা খিড়কি-দরজা পর্যন্ত ভিড় করিয়া আসিয়াছে।

বাড়ি অতিক্রম করিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিলাম। জঙ্গলে পাতা-ঝরা আরম্ভ হইয়াছে‌, গাছগুলি পত্রবিরল‌, মাটিতে স্বয়ংবিশীর্ণ পীতপত্রের আস্তরণ। বাড়ির খিড়কি হইতে পাঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরে একটা প্রকাণ্ড শিমুলগাছ‌, স্তম্ভের মতো স্থূল গুড়ি দশ-বারো হাত উঁচুতে উঠিয়া শাখা-প্রশাখাত্ত বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। পটল আমাদের শিমুলতলায় লইয়া গিয়া একটা স্থান নির্দেশ করিয়া’ বলিল‌, ‘এইখানে অমৃত মরে পড়ে ছিল।’

স্থানটি ঝরা-পাতা ও শিমুল-ফুলে আকীর্ণ‌, অপঘাত মৃত্যুর কোনও চিহ্ন নাই। তবু ব্যোমকেশ। স্থানটি ভালো করিয়া খুঁজিয়া দেখিল। কঠিন মাটির উপর কোনও দাগ নাই‌, কেবল শুকনা পাতার নিচে একখণ্ড খড়ি পাওয়া গেল। ব্যোমকেশ খড়িটি তুলিয়া ধরিয়া বলিল‌, ‘এই খড়ি দিয়ে অমৃত গাছের গায়ে ঢেরা কাটতে এসেছিল। কিন্তু গাছের গায়ে খড়ির দাগ নেই। সুতরাং–’

পটল বলিল‌, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, দাগ কাটবার আগেই–’

এখানে দ্রষ্টব্য আর কিছু ছিল না। আমরা ফিরিয়া চলিলাম। ফিরিবার পথে ব্যোমকেশ। বলিল‌, ‘সদানন্দ সুরের খিড়কির দরজা বন্ধ আছে কিনা একবার দেখে যাই।’

খিড়কির দরজা ঠেলিয়া দেখা গেল ভিতর হইতে হুড়কা লাগানো। প্ৰাচীন দরজার তক্তায় ছিদ্র আছে‌, তাহাতে চোখ লাগাইয়া দেখিলাম‌, উঠানের মাঝখানে একটি তুলসী-মঞ্চ‌, বাকী উঠান সুপ্রিয় ভরা। একটা পেয়ারাগাছ এককোণে পাঁচিলের পাশে দাঁড়াইয়া আছে‌, আর কিছু চোখে পড়িল না।

অতঃপর ব্যোমকেশ পাঁচিলের ধার দিয়া ফিরিয়া চলিল। তাহার দৃষ্টি মাটির দিকে। পাঁচিলের কোণ পর্যন্ত আসিয়া সে হঠাৎ আঙুল দেখাইয়া বলিল‌, ‘ও কি?’

0 Shares