৪
ব্যোমকেশ ও আমি চাতালের উপর উঠিলাম, আর যাহারা আমাদের পিছনে আসিয়াছিল। তাহার চাতালের কিনারায় দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে চক্ষু গোল করিয়া দেখিতে লাগিল।
সদানন্দ সুর যে বাঁচিয়া নাই তাহা একবার দেখিয়াই বোঝা যায়। তাহার শরীর অপেক্ষাকৃত অক্ষত বটে; ডান হাতে তালা ও বাঁ হাতে চাবি দৃঢ়ভাবে ধরা রহিয়াছে; কিন্তু মাথাটা প্রায় ধড় হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া উল্টা দিকে ঘুরিয়া গিয়াছে, রক্ত ও মগজ মাখামাখি হইয়া চুৰ্ণ খুলি হইতে গড়াইয়া পড়িতেছে; মুখের একপাশটা নাই। বীভৎস দৃশ্য। তিন মিনিট আগে যে-লোকটাকে জলজ্যান্ত দেখিয়াছি, তাহাকে এই অবস্থায় দেখিলে স্নায়ুবিক ত্ৰাসে শরীর কাঁপিয়া ওঠে, হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া যায়।
গ্রামবাসীদের এতক্ষণ বাকরোধ হইয়া গিয়াছিল। পটল প্রথম কণ্ঠস্বর ফিরিয়া পাইল; কম্পিত্যস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, এসব কী হচ্ছে আমাদের গ্রামে।’
ব্যোমকেশ ভাঙা দরজার নিকট হইতে ঢালাই লোহার একটা টুকরা কুড়াইয়া লইয়া পরীক্ষা করিতেছিল, পটলের কথা বোধ হয় শুনতে পাইল না। লোহার টুকরা ফেলিয়া দিয়া বলিল, ‘হ্যান্ড-গ্রিনেড! ক্যাম্বিসের ব্যাগটা কোথায় গেল?’
ব্যাগটা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় একপাশে ছিটকাইয়া পড়িয়া ছিল। ব্যোমকেশ গিয়া সেটার অভ্যন্তরভাগে পরীক্ষা করিল। নূতন ও পুরাতন কয়েকটা জামাকাপড় রহিয়াছে। একটা নূতন টাইম-পীস ঘড়ি বিস্ফোরণের ধাক্কায় চ্যাপ্টা হইয়া গিয়াছে, একটা কেশতৈলের বোতল ভাঙিয়া কাপড়-চোপড় ভিজিয়া গিয়াছে। আর কিছু নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, তুমি বাইরে থাকো, আমি চট্ট করে বাড়ির ভিতরটা দেখে আসি।’
শুধু যে দরজার কবাট ভাঙিয়া পড়িয়াছিল তাঁহাই নয়, দরজার উপরের খিলান খানিকটা উড়িয়া গিয়াছিল, কয়েকটা ইট বিপজ্জনকভাবে ঝুলিয়া ছিল। ব্যোমকেশ যখন লঘুপদে এই রন্ধ পার হইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। তখন আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। এই অভিশপ্ত বাড়ির মধ্যে কোথায় কোন ভয়াবহ মৃত্যু ওৎ পাতিয়া আছে কে জানে!–ব্যোমকেশের যদি কিছু ঘটে, সত্যবতীর সামনে গিয়া দাঁড়াইব কোন মুখে?
‘দাঁড়াও, আমিও আসছি—বলিয়া আমি প্রাণ হাতে করিয়া বাড়িতে ঢুকিয়া পড়িলাম।
ব্যোমকেশ ঘাড় ফিরাইয়া একটু হাসিল; বলিল, ‘ভায়ের কিছু নেই। বিপদ যা ছিল তা সদানন্দ সুরের ওপর দিয়েই কেটে গিয়েছে।’
এদিকে সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, বাড়ির ভিতরে আলো অতি অল্প। বলিলাম, ‘কি দেখবে চটপট দেখে নাও। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে।’
বাড়ির সামনের দিকে দু’টি ঘর, পিছনে রান্নাঘর। কোনও ঘরেই লোভনীয় কিছু নাই। যে ঘরের দরজা ভাঙিয়াছিল সে-ঘরে কেবল একটি কোমর-ভাঙা তক্তপোশ আছে; পাশের ঘরে আর একটি তক্তপোশের উপর বালিশ-বিছানা দেখিয়া বোঝা যায় ইহা গৃহস্বামীর শয়নকক্ষ। একটা খোলা দেওয়াল-আলমারিতে কয়েকটা ময়লা জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই নাই।
রান্নাঘরও তথৈবচ। খানকয়েক থালা-বাটি, ঘটি-কলসী, হাঁড়িকুড়ি। উনুনটা অপরিষ্কার, তাহার গর্ভে ছাই জমিয়া আছে। সব দেখিয়া শুনিয়া বলিলাম, সদানন্দ সুরের অবস্থা ভালো ছিল না মনে হয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। ওই দরজাটা দেখেছি? বলিয়া দ্বারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। কাছে গিয়া দেখিলাম। রান্নাঘরের এই দরজা দিয়া উঠানে যাইবার পথ। দরজা ভেজানো রহিয়াছে, টান দিতেই খুলিয়া গেল। বলিলাম, ‘একি? দরজা খোলা ছিল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সদানন্দ সুর খুলে রেখে যাননি। হুড়কো লাগিয়ে গিয়েছিলেন। ভালো করে দ্যাখো।’
ভালো করিয়া দেখিলাম, দ্বারের পাশে হুড়কো ঝুলিতেছে, কিন্তু তাহার দৈর্ঘ্য বড়জোর হাতখানেক। বলিলাম, ‘একি, এতটুকু হুড়কো।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝতে পারলে না? হুড়কোটা প্রমাণ মাপেরই ছিল এবং লাগানো ছিল। তারপর কেউ বাইরে থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে করাত ঢুকিয়ে ওটাকে কেটেছে, তারপর ঘরে ঢুকেছে। ওই দ্যাখো হুড়কের বাকী অংশটা।’ ব্যোমকেশ দেখাইল, উনানের পাশে জ্বালানী কাঠের সঙ্গে হুড়কের বাকী অংশটা পড়িয়া আছে।
ব্যাপার কতক আন্দাজ করিতে পারিলেও সমগ্র পরিস্থিতি ধোঁয়াটে হইয়া রহিল। সদানন্দ সুরের কোনও শত্ৰু তাঁহার অনুপস্থিতিকালে হুড়কো কাটিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছিল। তারপর? আজ বোমা ফাটিল কি করিয়া? কে বোমা ফাটাইল?
খোলা দরজা দিয়া আমরা উঠানে নামিলাম। পাঁচলা-ঘেরা উঠানের এককোণে কুয়া, অন্য কোণে পেয়ারাগাছ। ব্যোমকেশ সিধা পেয়ারাগাছের কাছে গিয়া মাটি দেখিল। মাটিতে যে অস্পষ্ট দাগ রহিয়াছে তাহা হইতে আমি কিছু অনুমান করিতে পারিলাম না, কিন্তু ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হুঁ, যা সন্দেহ করেছিলাম। তাই। যিনি এসেছিলেন তিনি এইখানেই পাঁচিল টপকেছিলেন।’
বলিলাম, ‘তাই নাকি! কিন্তু পাঁচল টপকাবার কী দরকার ছিল? করাত দিয়ে খিড়কি-দোরের হুড়কে কাটল না কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খিড়কির হুড়কো করাত দিয়ে কাটলে খিড়কি-দরজা খোলা থাকত, কারুর চোখে পড়তে পারত। তাতে আগন্তুক মহাশয়ের অসুবিধা ছিল। আমি গোড়াতেই ভুল বুঝেছিলাম, নইলে সদানন্দ সুর মরতেন না।’
‘কী ভুল বুঝেছিলে?’
‘আমি সন্দেহ করেছিলাম, যাঁকে ধরতে এখানে এসেছি তিনি সদানন্দ সুর। কিন্তু তা নয়।–চল, এখন যাওয়া যাক। বাঘমারি গ্রামে আর কিছু দেখবার নেই।’
রান্নাঘরের ভিতর দিয়া আবার সদরে ফিরিয়া আসিলাম। ইতিমধ্যে গ্রামের সমস্ত লোক আসিয়া জড়ো হইয়াছে এবং চাতালের নিচে ঘনসন্নিবিষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি মৃতদেহের পানে চাহিয়া আছে। মৃত্যু সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহলের অন্ত নাই।