অমৃতের মৃত্যু

ভিড়ের মধ্য হইতে পটল বলিয়া উঠিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, বাড়ির মধ্যে কী দেখলেন? কাউকে পেলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না। পুলিসে খবর পাঠিয়েছ?

পটল বলিল‌, ‘না। আপনি আছেন তাই—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি কেউ নয়‌, পুলিসকে খবর দিতে হবে। আচ্ছা‌, তোমাদের যেতে হবে। না; আমরা তো যাচ্ছি‌, সুখময়বাবুকে খবর দিয়ে যাব।’

‘আপনারা যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ। যতক্ষণ পুলিস না আসে ততক্ষণ তোমরা কয়েকজন। এখানে থেকে।’

‘পুলিস কি আজ রাত্রে আসবে?

‘আসবে।’

আমরা আবার রেল-লাইনের ধার দিয়া চলিয়াছি। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া চাঁদের আলো ফুটি-ফুটি করিতেছে। একটা মালগাড়ি দীর্ঘ দেহভার টানিয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে চলিয়া গেল।।

আমি বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, তুমি এ-ব্যাপারের কিছু কিছু বুঝেছি মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি।’

ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে এটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?’

‘সম্বন্ধ আছে নাকি? কী সম্বন্ধ?’

ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘অমৃত বেচারা বেঘোরে মারা গেল। সে-রাত্রে যদি সে জঙ্গলে না যেত তাহলে মরত না। যে তাকে মেরেছে সে তাকে মারতে আসেনি।’

‘তবে কাকে মারতে এসেছিল?’

‘সদানন্দ সুরকে।’

‘কিন্তু–সদানন্দ সুর তো তখন বাড়ি ছিলেন না।’

‘ছিলেন না বলেই আততায়ী এসেছিল তাঁকে মারতে।’

‘বড্ড বেশি রহস্যময় শোনাচ্ছে। অনেকটা কালিদাসের হেঁয়ালির মত-নেই তাই খাচ্ছ তুমি‌, থাকলে কোথায় পেতে!-কিন্তু যাক‌, আজ বোমা ফাটল কি করে?’

ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল‌, ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল‌, ‘বুবি-ট্র্যাপ কাকে বলে জানো?’

বলিলাম‌, ‘কথাটা শুনেছি। ফাঁদ পাতা?’

‘হ্যাঁ। সদানন্দ সুরকে একজন মারতে চেয়েছিল। সে যখন জানতে পারল সদানন্দ সুর বাইরে গেছেন‌, তখন একদিন সন্ধ্যের পর এসে পাঁচিল ডিঙিয়ে উঠোনে ঢুকাল‌, দরজার হুড়কে করাত দিয়ে কেটে বাড়িতে ঢুকল‌, তারপর বন্ধ সদর-দরজার মাথায় এমনভাবে একটা বোমা সাজিয়ে রেখে গেল যে‌, দরজা খুললেই বোমা ফাটবে। আজ সদানন্দ সুর ফিরে এসে দরজা খুললেন‌, অমনি বোমা ফাটল। এবার বুঝতে পেরেছ?’

‘বুঝেছি। কিন্তু লোকটা কে?’

‘এখনও নাম জানি না। কিন্তু তিনি অস্ত্রশস্ত্রের চোরাকারবার করেন এবং কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাত্ৰিবেলা যুদ্ধযাত্রা করেন। লোকটির নামধাম জািনবার জন্যে আমার মনটাও বড় ব্যগ্র হয়েছে।’

সান্তালগোলায় পৌঁছিয়া দেখিলাম দিনের কর্ম-কোলাহল শান্ত হইয়াছে‌, বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। থানা খোলা আছে‌, সুখময়বাবু টেবিলে বসিয়া কাগজপত্র দেখিতেছেন। আমাদের পদশব্দে তিনি চোখ তুলিলেন‌, ‘কী খবর?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খবর গুরুতর। বাঘমারিতে আর একটা খুন হয়েছে।’

‘খুন!’ সুখময়বাবু চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

‘হ্যাঁ। সদানন্দ সুরকে আপনি চেনেন?’

সুখময়বাবু ভ্রূকুটি করিয়া মাথা নাড়িলেন‌, ‘হয়তো দেখেছি‌, মনে পড়ছে না। সদানন্দ সুর খুন হয়েছে? কিন্তু আপনি সকলের আগে এ-খবর পেলেন কোথা থেকে?’

‘আমি বাঘমারিতে ছিলাম।’

সুখময়বাবুর মুখ হইতে ক্ষণেকের জন্য মিষ্টতার মুখোশ খসিয়া পড়ল, তিনি রূঢ়চক্ষে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘আপনি বাঘমারিতে গিয়েছিলেন। আমি মানা করা সত্ত্বেও গিয়েছিলেন।’

ব্যোমকেশের দৃষ্টিও প্রখর হইয়া উঠিল‌, ‘আপনি আমাকে মানা করবার কে?’

সুখময়বাবু কড়া সুরে বলিলেন‌, ‘আমি এ এলাকার বড় দারোগা‌, পুলিসের কর্তা।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনি পুলিসের হত্যকতা বিধাতা হতে পারেন‌, কিন্তু আমাকে হুকুম দেবার মালিক আপনি নন। ইন্সপেক্টর সামন্ত‌, আমি সরকারের কাজে এখানে এসেছি। আপনার ওপর হুকুম আছে সবরকমে আমাকে সাহায্য করবেন। কিন্তু সাহায্য করা দূরের কথা‌, আপনি পদে পদে বাগড়া দেবার চেষ্টা করছেন। আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি‌, ফের যদি আপনার এতটুকু বেচাল দেখি‌, আপনাকে এ-এলাকা ছাড়তে হবে। এমন কি চাকরি ছাড়াও বিচিত্র নয়।’

সুখময়বাবু বোধ করি ব্যোমকেশকে গোবেচারী মনে করিয়া এতটা দাপট দেখাইয়াছিলেন‌, এখন তাহাকে নিজমূর্তি ধারণ করিতে দেখিয়া একেবারে কেঁচো হইয়া গেলেন। তাঁহার মিষ্টতার মুখোশ পালকের মধ্যে আবার মুখে ফিরিয়া আসিল। তিনি কণ্ঠস্বরে বশংবদ দীনতা ঢালিয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘আমি কি-যে বলছি তার ঠিক নেই! আমাকে মাপ করুন‌, ব্যোমকেশবাবু। আজ বিকেল থেকে পেটে একটা ব্যথা ধরেছে‌, তাই মাথার ঠিক নেই। আপনাকে হুকুম করব আমি! ছি-ছি‌, কী বলেন। আপনি! আমি আপনার হুকুমের গোলাম। হো-হে। —ত সদানন্দ সুর খুন হয়েছে?’

ব্যোমকেশের তখনও মেজাজ ঠাণ্ডা হয় নাই; সে বলিল‌, ‘অমৃতের মৃত্যুর খবর পেয়ে আপনি সে-রত্রে তদন্ত করতে যাননি‌, পরদিন সকালবেলা গিয়েছিলেন। এ খবরটা আপনার ওপরওয়ালার কানে পৌঁছুলে তিনি কি করবেন তা বোধ হয় আপনার জানা আছে?’

সুখময়বাবু কাকুতিপূর্ণ স্বরে বলিলেন‌, ‘কি বলব ব্যোমকেশবাবু্‌, সেদিনও কলিকের ব্যথা ধরেছিল‌, হো-হে‌, একেবারে পেড়ে ফেলেছিল। নইলে খুনের খবর পেয়ে যাব না‌, এ কি সম্ভব! তা যাকগে ও-কথা। এখন এই সদানন্দ সুর—। আমি এখনি বেরুচ্ছি। এই জমাদার‌, জলদি ইধার আও! হামারা ঘোড়াপর জিন চড়ানে বোলো। তুম ভি তৈয়ার হো লেও। ভারী খুন হুয়া হ্যায়। আভি যানা পড়েগা।’

অতঃপর সুখময়বাবু রণসাজে সজ্জিত হইয়া অশ্বারোহণে যাত্ৰা করিবার উপক্রম করিতেছেন দেখিয়া আমরা চলিয়া আসিলাম। পাড়াগাঁয়ে পুলিসকে তদন্ত উপলক্ষে পথহীন মাঠে-ঘাটে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়‌, তাই বোধ করি তাহাদের ঘোড়ার ব্যবস্থা।

0 Shares