৫
পরদিন সকালবেলা প্ৰাতরাশের পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, স্টেশনে বেড়িয়ে আসা যাক।’ সকাল সাতটায় একটা ট্রেন চলিয়া গিয়াছে, আর একটা ট্রেন আসিবে ঘণ্টা দুই পরে। স্টেশনে ভিড় নাই, প্রবেশদ্বারে টিকিট-চোকার নাই। স্টেশনমাস্টার হরিবিলাসবাবু ছাড়া আর সকলেই বোধ করি এই অবকাশে নিজ নিজ কোয়াটারে চা খাইতে গিয়াছে।
হরিবিলাসবাবুর সহিত আমাদের পরিচয় হইয়াছিল। অত্যন্ত গভীর প্রকৃতির লোক, অজীৰ্ণ-জীর্ণ শরীর। ওজন করিয়া কথা বলেন, একটি কথা বলিবার আগে পাঁচবার অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেন। আমাদের সহিত পরিচয় হইলেও অধিক বাক্য-বিনিময় হয় নাই। আমরা আসিয়া যখন শূন্য প্ল্যাটফর্মের উপর অলসভাবে পায়চারি করিতে লাগিলাম, তখন তিনি অফিস-ঘর হইতে চশমার উপর দিয়া আমাদের লক্ষ্য করিলেন, কিন্তু উচ্চবাচ্য করিলেন না।
ব্যোমকেশ অবশ্য প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করিবার জন্য আসে নাই, সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আসিয়াছিল; কিন্তু সে হরিবিলাসবাবুর কাছে গেল না। তাঁহার নিকট হইতে সংবাদ সংগ্রহ করা এবং খনির গর্ভ হইতে মণিমাণিক্য আহরণ সমান শ্রমসাপেক্ষ। তার চেয়ে অন্য কেহ যদি আসিয়া পড়ে–
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না, টিকিট-চোকার মনোতোষ বোধ হয় নিজের কোয়ার্টার হইতে আমাদের দেখিতে পাইয়াছিল, মুখ মুছিতে মুছিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। ভারি তোখড় ছেলে, কথাবাতায় চটপটে। বলিল, ‘কী কাণ্ড, দাদা! আপনার চোখের সামনে এই ব্যাপার হল—অ্যাঁ।‘
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খবর পৌঁছে গেছে দেখছি!’
মনোতোষ বলিল, ‘খবর পৌঁছবে না! কাল রাত্রে দশটা সতরোর প্যাসেঞ্জার তখনও ইন হয়নি, খবর এসে হাজির। তা কী দেখলেন, দাদা! দুম করে আপনার চোখের সামনে বোমা ফাটল?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক চোখের সামনে বোমা ফাটেনি, তবে কানের সামনে বটে। আপনি সদানন্দ সুরকে চিনতেন?
‘চিনতাম না! চারটে তিপান্নর গাড়ি থেকে নামলেন, আমাকে টিকিট দিয়ে ব্যাগ হাতে করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি শুধোলাম–কি দাদা, কলকাতা গেছলেন দেখছি, কেমন বেড়ালেন। চেড়ালেন? উনি হেসে বললেন-কলকাতা কি বেড়াবার জায়গা, সেখানে গিয়ে চেড়ালাম। এই বলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। তখন কে জানতো আধঘণ্টাও কাটিবে না।’
আপনি তাঁকে দেখেছিলেন?’
মনোতোষ বলিল, ‘দেখিনি? আমার চোখ এড়িয়ে এ-ইস্টিশন থেকে কি কারুর বেরুবার জো আছে, দাদা। দিন আষ্ট্রেক-দশ আগেকার কথা; সকালবেলা আমাকে টিকিট দেখিয়ে ইস্টিশানে ঢুকলেন, সাতটা তিনের ডাউন প্যাসেঞ্জারে চলে গেলেন।’
‘কলকাতার টিকিট ছিল?’
‘অ্যাঁ-তা তো ঠিক মনে পড়ছে না, দাদা। তবে কলকাতা ছাড়া আর কি হতে পারে।’
‘কলকাতার দিকে অন্য স্টেশন হতে পারে।–সে যাক। তাঁর সঙ্গে কী কী মাল ছিল বলুন তো।’
‘মোল ‘—মনোতোষ একটু মাথা চুলকাইয়া বলিল, ‘যতদূর মনে পড়ছে, এক হাতে ক্যান্বিসের ব্যাগ, অন্য হাতে স্টীল-ট্রাঙ্ক ছিল। কেন বলুন তো?’
‘স্টীল-ট্রাঙ্কটা সদানন্দবাবু ফিরিয়ে আনেননি। তার মানে কোথাও রেখে এসেছিলেন। যাক, আপনি তো দেখছি লোকটিকে ভালোভাবেই চিনতেন। কেমন মানুষ ছিলেন তিনি?’
‘ঐটি বলতে পারব না, দাদা। পরচিত্ত অন্ধকার। তবে কথাবাতায় ভালো ছিলেন। কারুর সাতে-পাঁচে থাকতেন না, নিজের ধান্দায় ঘুরতেন। মাসখানেক আগে আমাদের মাস্টারমশায়ের কাছে খুব যাতায়াত ছিল।’—বলিয়া স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে আঙুল দেখাইল।
‘তাই নাকি! কিসের জন্যে যাতায়াত?’
‘তা জানিনে, দাদা। দু’জনে মুখোমুখি বসে কী গুজ-গুজ ফুস্-ফুস্ করতেন ওঁরাই জানেন।
আপনি মাস্টারমশাইকে শুধোন না।’
‘হুঁ, তাই করি।’
হরবিলাশবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াইলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘মাস্টারমশাই, আসতে পারি?’
হরিবিলাসবাবু এমনভাবে ভ্রূ তুলিয়া চাহিলেন যেন আমাদের চিনিতেই পারেন নাই। তারপর, কাজে বিঘ্ন করার জন্য বিরক্ত হইয়াছেন এমনিভাবে হাতের কলম রাখিয়া বলিলেন, ‘আসুন।’
আমরা ঘরে গিয়া বসিলাম। বহু খাতাপত্রে ভারাক্রান্ত প্রকাণ্ড টেবিলের ওপারে তিনি, এপারে আমরা। ব্যোমকেশ বলিল, ‘সদানন্দ সুর মারা গেছেন শুনেছেন বোধ হয়?’
হরিবিলাসবাবু প্রশ্নটাকে অত্যন্ত সন্দিগ্ধভাবে পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, ‘শুনেছি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাঁর সঙ্গে আপনার জানাশোনা ছিল?’
যেন এই কথার উত্তরের উপর জীবন-মরণ নির্ভর করিতেছে এমনিভাবে গভীর বিবেচনার পর হরিবিলাসবাবু বলিলেন, ‘সামান্য জানাশোনা ছিল।’
ব্যোমকেশ ঈষৎ অধীর কণ্ঠে বলিল, ‘দেখুন, আপনি মনে করবেন না, নাহক কৌতুহলের বশেই আপনাকে প্রশ্ন করছি। অত্যন্ত ভয়াবহভাবে সদানন্দবাবুর মৃত্যু হয়েছে, আমি পুলিসের পক্ষ থেকে তারই তদন্ত করতে এসেছি। —এখন বলুন, কোন সূত্রে সদানন্দবাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল।’
হরিবিলাসবাবুর চোপ্রসানো মুখ যেন আরও চুপসিয়া গেল। তিনি দু’চার বার গলা-ঝাড়া দিয়া অত্যন্ত দ্বিধাসকুল কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিলেন,–’সদানন্দ সুরের ভগিনীপতি প্রাণকেষ্ট পাল রেলের লাইন-ইন্সপেক্টর, তাঁর সঙ্গে আমার আগে থাকতে পরিচয় আছে। মাসিকয়েক হল প্রাণকেষ্টবাবু এ-লাইনে এসেছেন; রামডিহি জংশনে তাঁর হেড-কোয়ার্টার। ট্রলিতে চড়ে রেলের লাইন পরিদর্শন করে বেড়ানো তাঁর কাজ। কাজের উপলক্ষে সান্তালগোলা দিয়ে তিনি প্ৰায় যাতায়াত করেন, আমার সঙ্গে দেখা হয়। একদিন প্রাণকেষ্টবাবু এসেছেন, আমি তাঁর সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথা কইছি, এমন সময় সদানন্দবাবু প্ল্যাটফর্মে এলেন। প্ৰাণকেষ্টবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন; বললেন-আমার সম্বন্ধী। সেই থেকে আমি সদানন্দবাবুকে চিনি।’