অর্থমনর্থম্‌

ব্যোমকেশ চেয়ারে আসিয়া বসিল, বলিল, ‘অপরাধীর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহের বিশেষ স্থান নেই। বসুন—আপনাকে সব কথা বলছি।’

ফণী বিছানায় উপবেশন করিল, আমি তাহার পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন, হত্যা দু’রকম হয়—এক, রাগের মাথায় হত্যা, যাকে crime of passion বলে; আর এক, সঙ্কল্প করে হত্যা। রাগের মাথায় যে—লোক খুন করে, তাকে ধরা কঠিন নয়—অধিকাংশ সময় সে নিজেই ধরা দেয়। কিন্তু যে লোক ভেবে-চিন্তে নিজেকে যথাসম্ভব সন্দেহমুক্ত করে খুন করে, তাকে ধরাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কে আসামী, তার নাম আমরা জানতে পারি না, পাঁচজন লোকের ওপর সন্দেহ হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আমরা কোন্ পথে চলব? তখন আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে—হত্যার প্রণালী থেকে হত্যাকারীর প্রকৃতি বোঝবার চেষ্টা করা।

‘বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি—হত্যাকারী লোকটা একাধারে বোকা এবং চতুর। সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত খুন করেছে অথচ নির্বোধের মত খুনের যা-কিছু প্রমাণ নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে। বলুন দেখি, সত্যবতী ছুঁচ দিয়ে খুন করবার কি দরকার ছিল? বাজারে কি ছুঁচ পাওয়া না? আর উইলখানা যত্ন করে লুকিয়ে রাখবার কোনও আবশ্যকতা ছিল কি? ছিঁড়ে ফেললেই তো সব ন্যাটা চুকে যেত। এ থেকে কি মনে হয়?’

ফণী হাতের উপর চিবুক রাখিয়া শুনিতেছিল, বলিল, ‘কি মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সে বোকমির ভান করতে পারে। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসামী যে হোক সে বুদ্ধিমান।

‘কিন্তু বুদ্ধিমান লোকও ভুল করে,বোকা সাজবার চেষ্টাও সব সময় সফল হয় না। এ ক্ষেত্রেও আসামী কয়েকটা ছোট ছোট ভুল করেছিল বলে আমি তাকে ধরতে পেরেছি।’

ফণী মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ভুল সে করেছিল?’

‘বলছি।’ ব্যোমকেশ পকেট হাটকাইয়া একটা সাদা কাগজ বাহির করিল—‘কিন্তু তার আগে এ বাড়ির একটা নক্সা তৈরি করে দেখাতে চাই। একটা পেন্সিল আছে কি? যে কোনও পেন্সিল হলেই চলবে।’

ফণীর বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা ছিল, তাহার ভিতর হইতে সে একটা লাল পেন্সিল বাহির করিয়া দিল।

পেন্সিলটা লইয়া ব্যোমকেশ ভাল করিয়া দেখিল, তারপর মৃদু হাস্যে সেটা পকেটে রাখিয়া দিয়া বলিল, ‘থাক, প্ল্যান্ আঁকবার দরকার নেই—মুখেই বলছি। অপরাধী ‍প্রধানত তিনটি ভুল করেছিল। প্রথমে—সে গ্রে’র অ্যানাটমির এক জায়গায় লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছিল; দ্বিতীয়—সে বাক্স টানবার সময় একটু শব্দ করে ফেলেছিল; আর তৃতীয়—সে আইন ভাল জানত না।’

ফণীর মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা একেবারে মড়ার মত হইয়া গিয়াছিল, সে অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল,‘আইন জানত না?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আর সেই জন্যেই তার অতবড় অপরাধটা ব্যর্থ হয়ে গেল।’

শুঙ্ক অধর লেহন করিয়া ফণী বলিল, ‘আপনি কি বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সুকুমারবাবুর ঘর থেকে যে উইলটা বেরিয়েছে—উইল হিসেবে সেটা মূল্যহীন। তাতে সাক্ষীর দস্তখত নেই।’

মনে হইল, ফণী এবার মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইবে। অনেকক্ষণ কেহ কোনও কথা বলিল না; দৃষ্টিহীন শুঙ্ক চক্ষু মেলিয়া ফণী মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করিয়া ধরিয়া অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল, ‘সব বৃথা—সব মিছে—’ ব্যোমকেশবাবু, আমাকে একটু সময় দিন, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘাড় নাড়িল, ‘আধ ঘণ্টা সময় আপনাকে দিলুম—তৈরি হয়ে নিন।’ দ্বার পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘থিম্বলটা অবশ্য’ ফেলে দিয়েছেন; সেটা সুকুমারের ঘরে রেখে আসেননি কেন বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়িতে আঙুল থেকে খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন—না? তাই হবে। কিন্তু ক্লোরোফর্ম কার হাত দিয়ে আনালেন? মাখন?’

ফণী বিছানায় শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘আধ ঘণ্টা পরে আসবেন—’

দ্বার ভেজাইয়া দিয়া আমরা নীচে নামিয়া আসিয়া বসিলাম। মাখন তখনও ইনস্পেক্টর ও সাব-ইনস্পেক্টরের মধ্যবর্তী হইয়া দারুভুত জগন্নাথের মত বসিয়াছিল, ব্যোমকেশ ভীষণ ভ্রৃকুটি করিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কবে ফণীকে ক্লোরোফর্ম এনে দিয়েছ?’

মাখন চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘আমি কিছু জানি না—’

‘সত্যি কথা বল, নইলে ওয়ারেন্টে তোমার নামই লেখা হবে।’

মাখন কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘দোহাই আপনাদের, আমি এ সবের মধ্যে নেই। ফণী বলেছিল রাত্রে তার ঘুম হয় না, একফোটা করে ক্লোরোফর্ম খেলে ঘুম হবে—তাই—’

‘বুঝেছি। একে এবার ছেড়ে দিতে পারেন, বিধুবাবু।’

মুক্তি পাইয়া মাখন একেবারে বাড়ি ছাড়িয়া দৌড় মারিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওয়ারেন্ট এসেছে?’

বিধুবাবু বলিলেন, ‘না, এই এল বলে। কিন্তু কার জন্যে ওয়ারেন্ট?’

‘করালীবাবুকে যে খুন করেছে তার জন্য।’

বিধুবাবু অতিশয় অপ্রসন্নভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, এটা পরিহাসের সময় নয়। কমিশনার সাহেব আপনাকে একটু স্নেহ করেন বলে আপনি আমার ওপর হুকুম চালাচ্ছেন, তাও আমি সহ্য করেছি। কিন্তু তামাশা সহ্য করব না।’

‘তামাশা নয়—এ একেবারে নিরেট সত্যি কথা। শুনুন তবে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ সংক্ষেপে সমস্ত কথা বিধুবাবুকে বলিল। বিধুবাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়বিহুল হইয়া রহিলেন, তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘তাই যদি হয়, তবে তাকে একলা ফেলে এলেন কি বলে? যদি পালায়?’

‘পালাবে না; সে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে। আর সেইটেই আমাদের একমাত্র ভরসা; কারণ, তার অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা বিশেষ কঠিন হবে। জুরীদের আপনি জানেন তো—তারা ‘নট্ গিল্টি’ বলেই আছে।’

0 Shares