অর্থমনর্থম্‌

‘তা তো জানি—কিন্তু—’ বিধুবাবুর আবার বসিয়া পড়িলেন।

ঠিক আধ ঘণ্টা পরে আমরা ফণী ঘরে এলাম। বিধুবাবু সর্বপ্রথম দরজা খুলিয়া গটগট্ করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন।

ফণী বিছানয়া শুইয়া আছে, বিছানার পাশে তাহার ডান হাতটা ঝুলিতেছে; আর ঠিক তাহার নীচে মেঝের উপর পুরু হইয়া রক্ত জমিয়াছে। কব্জির কাটা ধমনী হইতে তখনও ফোঁটা ফোঁটা গাঢ় রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।

কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতটা আমি প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু এ ছাড়া তার উপায়ই বা ছিল কি?’

ফণীর বুকের উপর একখানা চিঠি রাখা ছিল; সেটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ পাঠ করিল। চিঠেতে এই কয়টি কথা লেখা—

‘ব্যোমকেশবাবু,

চলিলাম। আমি খোঁড়া অকর্মণ্য, এখানে আমার অন্ন জুটিবে না—দেখি ওখানে জোটে কি না।

আমি জানি,মোকাদ্দমা করিয়া আপনারা আমার ফাঁসি দিতে পারিতেন না। কিন্তু আমার বাঁচিয়া কোনও লাভ নাই; যখন টাকাই পাইলাম না,তখন কিসের সুখে বাঁচিব?

মামাকে খুন করিয়াছি সেজন্য আমার ক্ষোভ নাই; তিনি আমাকে ভালবাসিতেন না, খোঁড়া বলিয়া বিদ্রুপ করিতেন। তবে সুকুমারদার কাছে ক্ষমা চাহিতেছি। কিন্তু তিনি ছাড়া দোষ চাপাইবার লোক আর কেহ ছিল না।

তা ছাড়া, তিনি ফাঁসি গেলে আর একটা সুবিধা হইত। কিন্তু যে কথা নিজের বিকলাঙ্গতার লজ্জায় জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নাই আজ আর তাহা প্রকাশ করিব না।

ক্লোরোফর্ম কোথা হইতে পাইয়াছি তাহা বলিব না; যে আনিয়া দিয়াছিল সে আমার অভিসন্ধি জানিত না। তবে পরে হয়তো সন্দেহ করিয়াছিল।

আপনি আশ্চার্য লোক, থিম্বলের কথাটাও ভুলেন নাই। সেটা সত্যই আঙুল হইতে খুলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম; ঘরে ফিরিয়া আসিয়া চোখে পড়িল। সেটা এই ঘরেই আছে—খুঁজিয়া লইবেন। সেদিন রাত্রিতে সত্যবতীর ঘর হইতে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করিয়াছিলাম—সে তখন রান্নাঘরে ছিল।

আপনি ছাড়া আমাকে বোধহয় আর কেহ ধরিতে পারিত না কিন্তু তবু আপনাকে বিদ্বেষ করিতে পারতেছি না। বিদায়। ইতি—

বহুদূরের যাত্রী

ফণীভূষণ কর

চিঠিখানি বিধুবাবুর হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখন সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার বোধহয় আর কোনও বাধা নেই। তাঁর ভগিনীকেও জানানো দরকার। তিনি বোধহয় নিজের ঘরেই আছেন।–চল অজিত।’

সপ্তাহখানেক পরে আমরা দুইজনে আমাদের বসিবার ঘরে অধিষ্ঠিত ছিলাম। বৈকালবেলা নীরবে চা—পান চলিতেছিল।

গত কয়দিন অপরাহ্ণে ব্যোমকেশ নিয়মিত বাহিরে যাইতেছিল। কোথায় যায়, আমাকে বলে নাই, আমিও জিজ্ঞাসা করি নাই। তাহার কাছে মাঝে মাঝে এমন দু’একটা গোপনীয় কেস আসিত যাহার কথা আমার কাছেও প্রকাশ করিবার তাহার অধিকার ছিল না।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আজও বেরুবে না কি?’

ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ।’

একটু সঙ্কুচিতভাবে প্রশ্ন করিলাম, ‘নুতন কেস হাতে এসেছে, না?’

‘কেস? হ্যাঁ—কিন্তু কেসটা বড় গোপনীয়।’

আমি আর ও বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করিলাম না, বলিলাম, ‘সুকুমারের ব্যাপার সব চুকে গেছে?’

‘হ্যাঁ—প্রোবেটের দরখাস্ত করেছে।’

আমি বলিলাম, ‘আচ্ছা ব্যোমকেশ, ঠিক কিভাবে ফণী খুন করলে, আমাকে বুঝিয়ে বলতো; এখনও ভাল করে জট ছাড়াতে পারছি না।’

চায়ের শূণ্য পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা শোন, পর পর ঘটনাগুলো যেমন ঘটেছিল, বলে যাচ্ছি—

‘সেদিন দুপুরবেলা করালীবাবুর সঙ্গে মতিলালের ঝগড়া হল। সন্ধ্যেবেলা সুকুমার এসে তাই শুনে করালীবাবুকে বোঝাতে গেল। সেখান থেকে গালাগালি খেয়ে বেরিয়ে ফণীর ঘরে প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাটালে; তারপর খেয়েদেয়ে বায়স্কোপ দেখতে গেল। এ পর্যন্ত কোনও গোলমাল নেই।’

‘না।’

‘রাত্রি আটটার থেকে নয়টার মধ্যে—অর্থাৎ সত্যবতী যে সময় রান্নাঘরে ছিল, সেই সময় ফণী তার ঘর থেকে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করলে। সে বুঝতে পেরেছিল, করালীবাবুর আবার উইল বদলাবেন এবং এবার সে সম্পত্তি পাবে। সে ঠিক করলে, বুড়োকে আর মত বদলাবার ফুরসৎ দেবে না। বুড়োকে ফণী বিষচক্ষে দেখত; বিকলাঙ্গ লোকের একটা অদ্ভুত মানসিক দুর্বলতা প্রায়ই দেখা যায়—তারা নিজেদের দৈহিক বিকৃতি সম্বন্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে পারে না। ফণী বোধহয় অনেকদিন থেকেই করালীবাবুকে খুন করবার মতলব আঁটছিল। ‘বামুনঠাকুর এজেহার থেকে জানা যায়, রাত্রি আন্দাজ সাড়ে এগারোটার সময় মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। আমি হিসাব করে দেখেছি , মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ঠিক এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিটে। তার ও-দোষ বরাবরই ছিল—রাত্রে বাড়ি থাকত না।

‘সে বেরিয়ে যাবার পর ফণীও নিজের ঘর থেকে বেরুল। মতিলালের ঘর করালীবাবুর শোবার ঘরের ঠিক নীচেই, পাছে পায়ের শব্দ হয়, তাই ফণী এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। ঘুমন্ত করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল; তারপর সে তাঁর ঘাড়ে অপটু হস্তে ছুঁচ ফোটালে। তিনবার ফোটবার পর তবে ছুঁচ যথাস্থানে পৌছল। সুকুমারের মতন ডাক্তারি ছাত্র যদি একাজ করত, তাহলে তিনবার ফোটাবার দরকার হত না।

‘করালীবাবুকে শেষ করে ফণী পাশের ঘরের দেরাজ থেকে তাঁর শেষ উইল বার করলে—দেখলে, উইল তার নামেই বটে।

‘এখানে একটু সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনও হতে পারে যে, ফণী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করে পাশের ঘরে গিয়ে উইলটা পড়লে; যখন দেখলে উইল তারই নামে, তখন ফিরে এসে করালীবাবুকে খুন করলে। সে যাই হোক, এই ব্যাপারে তার দশ-বারো মিনিট সময় লাগল।

0 Shares