‘আজ্ঞে, হ্যাঁ—তিনি প্রায় রোজ রাত্তিরেই বাড়ি থাকেন না।’
‘আবার বাজে কথা! যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও। মতিলালবাবুকে তুমি উপর থেকে নেমে আসতে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে না হুজুর। তিনি যখন সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান, তখন দেখেছিলুম।’
‘উপর থেকে নামতে দেখনি! তুমি তখন কোথায় ছিলে?’
‘আজ্ঞে আমি—আজ্ঞে আমি—’
‘সত্যি বল, তুমি তখন কোথায় ছিলে?’
পাচক ভয়-কম্পিত স্বরে জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল, ‘আজ্ঞে ধর্মাবতার, আমার দেশের লোকেরা এ বাড়ির সামনে মেছ করে থাকে—তাই রাতের কাজকর্ম শেষ হলে তাদের আড্ডায় গিয়ে একটু বসি।’
‘ওঃ—তুমি তখন আড্ডায় বসে গাঁজায় দম দিচ্ছিলে!’
‘আজ্ঞে—’
‘সদর দরজা তাহলে খোলা ছিল?’
ভয়ে পাচকটা শুকাইয়া গিয়াছিল, অস্ফুট কণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ—’
বিধুবাবু কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করিয়া থাকিয়া বলিলেন, হুঁ। তাহলে রাত্রে বাড়িতে কারা আসা—যাওয়া করেছিল, তুমি আড্ডায় বসে বসে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে, আর কেউ বাড়ি থেকে বাড়ি থেকে বেরোননি।’
‘হুঁ। তুমি কখন বাড়ি ফিরলে?’
‘আজ্ঞে, মতিলালবাবু চলে যাবার আধঘণ্টা পরেই আমি বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে দিলুম। সুকুমারবাবু তার আগেই ফিরে এসেছিলেন।’
‘অ্যা! সুকুমারবাবু আবার কোথা থেকে ফিরে এসেছিলেন?’
‘তা জানি না হুজুর।’
‘তিনি কখন ফিরেছিলেন?’
‘মতিবাবু বেরিয়ে যাবার কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে।’
বিধুবাবুর ভ্রুকুটি গভীরতর হইল। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন, তারপর বলিলেন, ‘তুমি এখন যেতে পার। দরকার হলে আবার তোমার এজেহার হবে।’
পাচকঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া পলায়ন করিল। বিধুবাবু তখন ঘর হইতে অনক্য পুলিস—কর্মচারীদের সরিয়া যাইতে বলিলেন। ঘরে কেবল আমি আর ব্যোমকেশ রহিলাম। বিধুবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘দেখলেন তো, একজনকে জেরা করেই সব কথা বেরিয়ে পড়ল। ভাল করে জেরা করতে জানলে—যা হোক, আপনাকে গোড়া থেকে না বোঝালে আপনি বুঝতে পারবেন না। বাড়ির সকলের জবানবন্দী নিয়ে যেসব কথা জানা গেছে, তােই মোটামুটি আপনাকে বলছি—মন দিয়ে শুনুন।’
ব্যোমকেশ মাথা হেট করিয়া নীরবে কথা শুনিতে লাগিল। বিধুবাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘এই বাড়ির যিনি কর্তা ছিলেন, তার নাম করালীবাবু। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান ছিলেন। বেশ অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতায় চার-পাঁচখানা বাড়ি আছে, তা ছাড়া ব্যাঙ্কেও দু‘তিন লাখ টাকা জমা আছে।
‘স্ত্রী-পুত্র না থাকলেও তাঁর পুষ্যির অভাব নেই। তিনটি ভাগনে—মতিলাল, মাখনলাল আর ফণিভূষণ এবং শ্যালীর দুটি ছেলে-মেয়ে—সবসুদ্ধ এই পাঁচটি লোককে করালীবাবু প্রতিপালন করতেন। তারা সবাই এই বাড়িতে থাকে। তাদের তিন কুলে কেউ নেই।
‘যতদুর জানা যায়, করালীবাবু ভয়ঙ্কর ক্ষপিশ মেজাজের লোক ছিলেন। বাতব্যাধিতে পঙ্গু ছিলেন, বয়সও ষাট-বাষট্টি হয়েছিল—তাই নিজের ঘর থেকে বড় একটা বেরুতেন না। কিন্তু বাড়িসুদ্ধ লোক তাঁকে বাঘের মতন ভয় করত। তাঁর এক অদ্ভুদ পাগলামি ছিল—তিনি কেবলই নিজের উইল তৈরি করতেন। তাঁর তিনখানা উইল দেরাজ থেকে বেরিয়েছে। প্রথমটায় তিনি মাখনকে ওয়ারিস করে যান, দ্বিতীয়টায় ওয়ারিস মতিলাল, এবং সবশেষটায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি সুকুমারকে দিয়ে গেছেন। শেষ উইলটা তৈরি হয়েছে—পরশু। সুকুমারই এখন তাঁর ওয়ারিস।
‘করালীবাবু থেকে থেকে উইল বদলাবার কারণ ছিল এই যে, যখন যার ওপর তিনি চটতেন, তখনই তাকে উইল থেকে খারিজ করে দিতেন।
‘এই উইলের ব্যাপার নিয়ে কাল দুপুরবেলা মতিলালের সঙ্গে করালীবাবুর খুব একচোট ঝগড়া হয়ে যায়। মতিলালের শরীরে অনেক দোষ আছে—সে তাঁকে ‘ঘাটের মড়া’ ‘বাহাত্তুরে বুড়ো’ ইত্যাদি গালাগাল দিয়ে চলে আসে।
‘তারপর রাত্রি প্রায় বারোটার সময় মতিলাল চুপিচুপি বাড়ি থেকে পালায়—বামুন এবং চাকর দু’জনেই তাকে পালাতে দেখেছে। আজ সকালবেলা দেখা গেল, করালীবাবু তাঁর বিছানায় মরে পড়ে আছে।
‘কি করে মৃত্যু হল, প্রথমটা কেউ বুঝতে পারেনি। আমি এসে বার করলুম—তাঁর ঘাড়ে, ঠিক মেডালা আর ফার্স্ট ভার্টিরা‘র মাঝখানে একটা ছুঁচ আমুল ফুটিয়ে দিয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে।’
বিধুবাবু চুপ করিলে ব্যোমকেশ মুখ তুলিল, ‘ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! মেডালা আর ফার্স্ট সার্ভিক্ল ভার্টিব্রা‘র সন্ধিস্থলে ছুঁচ ফুটিয়ে খুন করেছে, এ যে একেবারে Bride of Lammermoor!’ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘মতিলালের নামে ওয়ারেন্ট বার করে দিয়েছেন? লোকটা কাজকর্ম কিছু করে কি না, খবর পাওয়া গেছে কি?’
বিধুবাবু বলিলেন, ‘কিছু না—কিছু না! থার্ড ক্লাস অবধি বিদ্যে, ঘোর বয়াটে। মামার অন্ন মারত, আর বেলেল্রাগিরি করে বেড়াত।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর মাখনলাল?’
‘তিনিও প্রায় দাদার মত, তবে অতটা নয়। কোকেন, গাঁজা-টাজা খায় বটে, কিন্তু দাদার মত এখনও নাম-কাটা সেপাই হয়ে ওঠেনি।’
‘আর ফণিভূষণ?’
‘তিনি আবার খোঁড়া। কথায় বলে—কানা খোঁড়া এক গুণ বাড়া, কিন্তু এ ছোড়া বোধহয় অতটা খারাপ নয়। তার কারণ, খোঁড়া বলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না। তিন ভাইয়ের মধ্যে এই ফণিভূষণই একটু মানুষের মতন বোধ হল।’
‘আর সুকুমার?’
‘সুকুমার বেশ ভাল ছেলে, মেডিক্যাল কলেজের ফিফথ ইয়ারে পড়ে। তার বোন সত্যবতীও কলেজে পড়ে। এরা দুই ভাই-বোনে বুড়োর যা কিছু সেবা-শুশ্রুষা করত।’
‘এরা সকলেই বোধহয় অবিবাহিত?’
‘হ্যা—মেয়েটিও।’