বারান্দা যেখানো মোড় ফিরিয়াছে, সেই কোণের উপর মেয়েটির ঘর; বিধুবাবু গিয়া দরজায় টোকা মারিলেন। আধ মিনিট পরে সতের-আঠারো বছরের মেয়ে দরজা খুলিয়া আমাদের দেখিয়া কবাটের পাশে সরিয়া দাড়াইল। আমরা সঙ্কুচিত-পদে ঘরে প্রবেশ করিলাম। সুকুমারও আমাদের পিছনে পিছনে আসিয়াছিল, সে গিয়া ক্লান্তভাবে বিছানায় বসিয়া পড়িল।
ঘরে ঢুকিবার সময় মেয়েটিকে একবার দেখিয়া লইয়াছিলাম। তাহার গায়ের রঙ ময়লা, লম্বা রোগা গোছের চেহারা, কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ দু’টি লাল হইয়া উঠিয়াছে, মুখও ঈষৎ ফুলিয়াছে; সুতরাং সে সুশ্রী কি কুশ্রী, তাহা বুঝিবার উপায় নাই। মাথার চুল রুক্ষ। এই শোকে অবসন্ন মেয়েটিকে জেরা করার নিষ্ঠুরতার জন্যে মনে মনে ব্যোমকেশের উপর রাগ হইতেছিল, কিন্তু তাহার কুণ্ঠার আড়ালে যে এক দৃঢ় সঙ্কল্পিত উদ্দেশ্য রহিয়াছে, তাহও বুঝিতে পারিতেছিলাম। ব্যোমকেশ মেয়েটিকে একট নমস্কার করিয়া বিনীতভাবে বলিল, ‘আপনাকে একটু কষ্ট দেব, কিছু মনে করবেন না। এ রকম একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা যখন বাড়িতে হয়ে যায়, তখন বোঝার ওপর শাকের আঁটির মত পুলিসের ছোটখাটো উৎপাতও সহ্য করতে হয়—’
বিধুবাবু ফোঁস করিয়া উঠিলেন, ‘পুলিসের নামে বদনাম দেবেন না, আপনি পুলিস নন।’
ব্যোমকেশ সেদিকে কর্ণপাত না করিয়া বলিল, ‘বেশি নয়, দু’ একটা সাধারণ প্রশ্ন আপনাকে করব। বসুন ।’ বলিয়া ঘরের একটি মাত্র চেয়ার নির্দেশ করিল।ভ
মেয়েটি বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার ব্যোমকেশের দিকে তাকাইল। তারপর চাপা ভাঙা গরায় বলিল, ‘আপনি কি জানতে চান, বলুন। আমি দাঁড়িয়েই জবাব দিচ্ছি।’
‘বসবেন না? আচ্ছা, আমিই তাহলে বসি।’ চেয়ারে বসিয়া ব্যোমকেশ একবার ঘরের চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। এ ঘরটিও সুকুমারের ঘরের মত অত্যন্ত সাদাসিধা—আসবাবের বাহুল্য নাই। খাট, চেয়ার, বইয়ের আলমারি; বাড়তির মধ্যে একটা দেরাজযুক্ত ড্রেসিং টেবিল।
কড়িকাঠের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকাইয়া ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনিই রোজ সকালে করালীবাবুকে ডাকতেন?’
মেয়েটি নীরবে ঘাড় নাড়িল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ তাহলে চা দিতে গিয়ে আপনি প্রথম জানতে পারলেন যে তিনি মারা গেছেন?’
মেয়েটি আবার ঘাড় নাড়িল।
‘তার আগে আপনি কিছু জানতেন না?’
বিধুবাবু গলার মধ্যে গজ্গজ্ করিয়া বলিলেন, ‘বাজে প্রশ্ন, বাজে প্রশ্ন। একেবারে foolish!’
ব্যোমকেশ যেন শুনিতে পায় নাই, এমনিভাবে বলিল, ‘রাত্রিতে করালীবাবুর দরজা খোলা থাকত?’
‘হ্যাঁ। এ বাড়ির কারুর দরজা বন্ধ করে শোবার হুকুম ছিল না। মেসোমশাই নিজেও রাত্রিতে দরজা খুলে শুতেন।’
‘বটে! তাহলে—’
বিধুবাবু আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘ঢের হয়েছে, এবার উঠুন। যত সব বাজে প্রশ্ন করে বেচারীকে বিরক্ত করবার দরকার নেই। আপনি ক্রস্ একজামিন করতে জানেন না—’
এতক্ষণে ব্যোমকেশের বিনীতভাবের মুখোশ খসিয়া পড়িল। খোঁচা-খাওয়া বাঘের মত সে বিধুবাবুর দিকে ফিরিয়া তীব্র অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে কহিল, ‘যদি বার বার বিরক্ত করেন, তাহলে কমিশনার সাহেবকে জানাতে বাধ্য হবে যে, আপনি আমার অনুসন্ধানে বাধা দিচ্ছেন। আপনি জানেন, এ ধরণের কেস সাধারণ পুলিসের এলাকায় পড়ে না—এটা সি আই ডি’র কেস?’
গালে চড় খাইলেও বোধ করি বিধুবাবু এত স্তম্ভিত হইতেন না। তিনি আরক্তচক্ষুতে কটমট করিয়া কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের পানে তাকাইয়া রহিলেন। তারপার একটা অর্ধোচ্চারিত কথা গিলিয়া ফেলিয়া গট্গট্ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
ব্যোমকেশ মেয়েটির দিকে ফিরিয়া আবার আরম্ভ করিল, ‘আপনি করালীবাবুর মৃত্যুর কথা জানতেন না? ভেবে দেখুন।’
‘ভেবে দেখেছি, জানতুম না।’ মেয়েটির গলার আওয়াজে একটু জিদের আভাস পাওয়া গেল। ব্যোমকেশ কিছুক্ষাণ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া চুপ করিয়া রহিল। তারপর বলিল, ‘যাক। এখন আর একটা কথা বলুন তো, করালীবাবু চায়ে ক’ চামচ চিনি খেতেন?’
মেয়েটি এবার অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল, শেষে বলিল, ‘চিনি? মেসোমশাই চায়ে চিনি একটু বেশি খেতেন, তিন-চার চামচ দিতে হত—’
বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন হইল, ‘তবে আজ চায়ে আপনি চিনি দেননি কেন?’
মেয়েটির মুখ একেবারে ছাইয়ের মত হইয়া গেল, ত্রাস-বিস্ফারিত নয়নে সে একবার চারিদিকে চাহিল। তারপর অধর দংশন করিয়া অতিকষ্টে নিজেকে সম্বরণ করিয়া বলিল, ‘বোধহয় মনে ছিল না, কাল থেকে আমার শরীরটা ভাল নেই—’
‘কাল কলেজে গিয়েছিলেন?’
অস্পষ্ট অথচ বিদ্রোহপূর্ণ উত্তর হইল, ‘হ্যাঁ।’
অলসভাবে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সব কথা খুলে বললে আমাদের অনেক সুবিধা হয়, আপনাদেরও হয়তো সুবিধা হতে পারে।’
মেয়েটি ঠোট টিপিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, উত্তর দিল না।
ব্যোমকেশ আবার বলিল, ‘সব কথা বলবেন কি?’
মেয়েটি আস্তে আস্তে কাটিয়া কাটিয়া বলিল, ‘আমি আর কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিল। এতক্ষণ সে টেবিলের উপর রক্ষিত একটা সেলাইয়ের বাক্সের দিকে চাহিয়া কথা কহিতেছিল, এবার টেবিলের নিকট গিয়া দাঁড়াইল। বাক্সটা নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘এটা আপনার বোধ হয়?’
‘হ্যাঁ।’
বাক্সটা ব্যোমকেশ খুলিল। বাক্সর মধ্যে একটা অসমাপ্ত টেবিল-ক্লথ ও নানা রঙের রেশমী সুতা তাল পাকানো ছিল। সুতার তালটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ নিজমনেই বলিতে লাগিল, ‘লাল, বেগুনী, নীল, কালো—হুঁ—কালো—’ সুতা রাখিয়া দিয়া বাক্সর মধ্যে কি খুঁজিল, পাট-করা টেবিল-ক্লথটা খুলিয়া দেখিল; তারপর মেয়েটির দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘ছুঁচ কই?’