অর্থমনর্থম্‌

ফণী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল—‘রাত্রি বারোটার সময়! ওঃ—হ্যাঁ, তিনি বায়স্কোপে গিয়েছিলেন!’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘করালীবাবুকে ক’টার সময় খুন করা হয়েছে, আপনি আন্দাজ করতে পারেন? কোন রকম শব্দ-টব্দ শুনেছিলেন কি?’

‘কিছু না। হয়তো শেষ রাত্রে—’

‘উহুঁ—তিনি রাত্রি বারোটায় খুন হয়েছেন।’ ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘উঃ, আড়াইটে বেজে গিয়েছে—আর না, চল হে অজিত। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে—আপনাদেরও তো এখনও খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি—নমস্কর।’

এমন সময় নীচে একটা গণ্ডগোল শোনা গেল; পরক্ষণেই আমাদের ঘরের দরজা সজোরে ঠেলিয়া একজন লোক উত্তেজিতভাবে বলিতে বলিতে ঢুকিল, ‘ফণী, দাদাকে অ্যারেস্ট করে এনেছে—’ আমাদের দেখিয়াই সে থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনিই মাখনবাবু?’

মাখন ভয়ে কুঁচকাইয়া গিয়া ‘আমি—আমি কিছু জানি না।’ বলিয়া সবেগে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল।

নীচে নামিয়া দেখিলাম, বসিবার ঘরে হুলস্থুল কাণ্ড। বিধুবাবু ঘরে নাই, থানার ইনস্পেক্টর তাঁহার স্থান অধিকার করিয়াছেন। একটা পাগলের মত চেহারার হাতকড়া-পরা লোককে দু’জন কনস্টেবল ধরিয়া আছে আর সে হাউমাউ করিয়া বলিতেছে, ‘মামা খুন হয়েছেন? দোহাই মশাই, আমি কিছু জানি না—যে দিব্যি গালতে বলেন গালছি—আমি মাতাল দাঁতাল লোক—ডালিমের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি—ডালিম সাক্ষী আছে—’

ইনস্পেক্টরবাবুটি সত্য সত্যই কাজের লোক,এতক্ষণ নিস্পৃহভাবে বসিয়াছিলেন, আমাদের দেখিয়া বলিলেন, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু, ইনিই মতিলাল—বিধুবাবুর আসামী। যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান, করতে পারেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কোথায় একে গেপ্তার করা হল?’

যে সাব-ইনস্পেক্টরটি গ্রেপ্তার করিয়াছিল, সে বলিল, ‘হাড়কাটা গলির এক স্ত্রীলোকের বাড়িতে—’

মতিলাল আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ‘ডালিমের বাড়িতে ঘুমুচ্ছিলুম—কোন্ শালা মিছে কথা বলে—’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া তাহাকে নিবারণ করিয়া বলিল, ‘আপনি তো ভোর না হতেই বাড়ি ফিরে আসেন, আজ ফেরেননি কেন?’

পাগলের মত আরক্ত চক্ষে চারিদিকে চাহিয়া মতিলাল বলিল, ‘কেন? আমি—আমি মদ খেয়েছিলুম—দু’বোতল হুইস্কি টেনেছিলুম—ঘুম ভাঙেনি—’

ব্যোমকেশ ইনস্পেক্টবাবুর দিকে চাহিয়া ঘাড় নাড়িল, তিনি বলিলেন,, ‘নিয়ে যাও—হাজতে রাখো—’

মতিলাল চীৎকার করিতে করিতে স্থানান্তরিত হইলে, ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিধুবাবু কোথায়?’

‘তিনি মিনিট পনের হল বাড়ি গেছেন—আবার চারটের সময় আসবেন।’

‘আচ্ছা, তাহলে আমরাও উঠি, কাল সকাল আবার আসব। ভাল কথা, বাড়ির ঘরগুলো সব খানাতল্লাস হয়েছে?’

‘করালীবাবুর আর মতিলালের ঘর খানাতল্লাস হয়েছে, অন্য ঘরগুলো খানাতল্লাস করা বিধুবাবুর দরকার মনে করেননি।’

‘মতিলালের ঘর থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’

‘কিছু না।’

‘উইলগুলো দেখা হল না, সেগুলো বোধহয় বিধুবাবু সীল করে রেখে গেছেন। থাক, কাল দেখলেই হবে। আচ্ছা,চললুম। ইতিমধ্যে যদি নতুন কিছু জানতে পারেন, খবর দেবেন।’

বাসায় ফিরিলাম। রাত্রে করালীবাবুর বাড়ির একটা নক্সা তৈয়ার করিয়া ব্যোমকেশ আমাকে দেখাইল, বলিল, ‘করালীবাবুর ঘরের নীচে মতিলালের ঘর; মাখনের ঘর তার পাশে। ফণীর ঘরের নীচে বৈঠকখানাঘর অর্থাৎ যেখানে পুলিস আড্ডা গেড়েছে। সত্যবতীর ঘরের নীচে রান্নাঘর, আর সুকুমারের ঘরের নীচের ঘরে চাকর বামুন শোয়।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ প্ল্যান্ কি হবে?’

‘কিছু না।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নক্সাটা মনোনিবেশ সহকারে দেখিতে লাগিল। আমি বলিলাম, ‘তোমার কি রকম মনে হচ্ছে? মতিলাল বোধহয় খুন করেনি—না?’

‘না—সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।’

‘তবে কি?’

‘সেইটে বলাই শক্ত, মতিলালকে বাদ দিলে চারজন বাকী থেকে যায়—ফণী,মাখন,সুকুমার আর সত্যবতী। এদের মধ্যে যে কেউ খুন করতে পারে। সকলের স্বার্থ প্রায় সমান।’

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘সত্যবতীও?’

‘নয় কেন?’

‘কিন্তু মেয়েমানুষ হয়ে—’

‘মেয়েমানুষ যাকে ভালবাসে, তার জন্যে করতে পারে না, এমন কাজ নেই।’

‘কিন্তু তার স্বার্থ কি? করালীবাবুর শেষ উইলে তার ভাই-ই তো সব পেয়েছে।’

‘বুঝলে না? যে লোক ঘণ্টায় ঘণ্টায় মত বদলায়, তাকে খুন করলে আর তার মত বদলাবার অবকাশ থাকে না।’

স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। এদিক হইতে কথাটা ভাবিয়া দেখি নাই। বলিলাম, ‘তবে কি তোমার মনে হয়—সত্যবতীই—?’

‘আমি তা বলিনি। সুকুমার হতে পারে, সম্পূর্ণ বাইরের লোকও হতে পারে। কিন্তু সত্যবতী মেয়েটি সাধারণ মেয়ে নয়।’

খানিক্ষন চুজ করিয়া ভাবিতে লাগিলাম। গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত প্রকার খাপছাড়া ও পরস্পর-বিরোধী মালমশলা আমাদের হস্তগত হইয়াছিল যে, তাহার ভিতর হইতে সুসংলগ্ন একটা কিছু বাহির করা প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। ব্যাপারটা এতই জটিল যে, ভাবিতে গেলে আরও জট পাকাইয়া যায়।

শেষে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মৃতদেহ দেখে তুমি কি বুঝলে?’

‘এই বুঝলাম যে,হত্যা করবার আগে হত্যাকারী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করেছিল।’

‘কি করে বুঝলে?’

‘তাঁর ঘাড়ে হত্যাকারী তিনবার ছুঁচ ফুটিয়েছিল। ক্লোরোর্ফম না করলে তিনি জেগে উঠতেন। তাঁর নাকে ছোট দাগ দেখেছিলে মনে আছে? সেগুলো ক্লোরোর্ফমের চিহ্ন।’

‘তিনবার ছুঁচ ফোটাবার মানে?’

‘মানে, প্রথম দু’বার মর্মস্থানটা খুঁজে পায়নি। কিন্তু সেটা তেমন জরুরী কথা নয়; জরুরী কথা হচ্ছে এই যে, ছুঁচটা বিঁধিয়ে রেখে গেল কেন? কাজ হয়ে গেলে বার করে নিয়ে চলে গেলেই তো আর কোনও প্রমাণ থাকত না।’

0 Shares