আদিম রিপু

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হইতে বাংলা দেশে‌, বিশেষত কলিকাতা শহরে‌, মানুষের জীবনের মূল্য খুবই কমিয়া গিয়াছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে আমরা জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করিয়া ফেলিয়ছিলাম। তারপর জিন্না সাহেবের সম্মুখ সমর যখন আরম্ভ হইল‌, তখন আমরা মৃত্যু দেবতাকে একেবারে ভালবাসিয়া ফেলিলাম। জাতি হিসাবে আমরা যে টিকিয়া আছি‌, সে কেবল মৃত্যুর সঙ্গে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর করিতে পারি বলিয়াই। বাঘ ও সাপের সঙ্গে আমরা আবহমানকাল বাস করিতেছি‌, আমাদের মারে কে?

সম্মুখ সমরের প্রথম অনলোদগার প্রশমিত হইয়াছে; কিন্তু তলে তলে অঙ্গার জ্বলিতেছে‌, এখানে ওখানে হঠাৎ দপ করিয়া জ্বলিয়া আবার ভম্মের অন্তরালে লুকাইতেছে। কলিকাতার সাধারণ জীবনযাত্রায় কিন্তু কোনও প্ৰভেদ দেখা যায় না। রাস্তায় ট্রাম-বাস তেমনি চলিতেছে‌, মানুষের কর্মতৎপরতার বিরাম নাই। দুই সম্প্রদায়ের সীমান্ত ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে হৈ হৈ দুমদাম শব্দ ওঠে‌, চকিতে দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায়‌, রাস্তায় দুই চারিটা রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়িয়া থাকে। সুরাবর্দি সাহেবের পুলিস আসিয়া হিন্দুদের শাসন করে‌, মৃতদেহের সংখ্যা দুই চারিটা বাড়িয়া যায়। কোথা হইতে মোটর ভ্যান আসিয়া মৃতদেহগুলিকে কুড়াইয়া লইয়া অন্তধান করে। তারপর আবার নগরীর জীবনযাত্রা পূর্ববৎ চলিতে থাকে।

ব্যোমকেশ ও আমি কলিকাতাতেই ছিলাম। আমাদের হ্যারিসন রোডের বাসাটা যদিও ঠিক সমর সীমানার উপর পড়ে না‌, তবু যথাসাধ্য সাবধানে ছিলাম। ভাগ্যক্রমে কয়েক মাস আগে ব্যোমকেশের শ্যালক সুকুমার খোকাকে ও সত্যবতীকে লইয়া পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়াছিল‌, তাই সম্মুখ সমর যখন আরম্ভ হইল তখন ব্যোমকেশ তার করিয়া তাহাদের কলিকাতায় ফিরিতে বারণ করিয়া দিল। তদবধি তাহারা পাটনায় আছে। ইতিমধ্যে সত্যবতীর প্রবল পত্রাঘাতে আমরা বার দুই পাটনা ঘুরিয়া আসিয়াছি; কারণ আমরা যে বাঁচিয়া আছি‌, তাহা মাঝে মাঝে স্বচক্ষে না দেখিয়া সত্যবতী বিশ্বাস করিতে চাহে নাই।

যাহোক‌, খোকা ও সত্যবতী নিরাপদে আছে‌, ইহাতেই আমরা অনেকটা নিশ্চিন্তু ছিলাম। রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় নিজের প্রাণ রক্ষার চেয়ে প্রিয়জনের নিরাপত্তাই অধিক বাঞ্ছনীয় হইয়া ওঠে।

যেদিনের ঘটনা লইয়া এই কাহিনীর সূত্রপাত সেদিনটা ছিল দুৰ্গাপূজা এবং কালীপূজার মাঝামাঝি একটা দিন। দুৰ্গাপূজা অন্যান্য বারের মত যথারীতি ধুমধামের সহিত সম্পন্ন হইয়াছে এবং কালীপূজাও যথাবিধি সম্পন্ন হইবে সন্দেহ নাই। আমরা দু’জনে সকালবেলা খবরের কাগজ লইয়া বসিয়াছিলাম‌, এমন সময় বাঁটুল সদর আসিল। তাহাকে সেলামী দিলাম। বাঁটুল এই এলাকার গুণ্ডার সদর; বেঁটে নিটোল চেহারা‌, তৈলাক্ত ললাটে সিঁদুরের ফোঁটা। সম্মুখ সমর আরম্ভ হইবার পর হইতে বাঁটুলের প্রতাপ বাড়িয়াছে‌, পাড়ার সজ্জনদের গুণ্ডার হাত হইতে রক্ষা করিবার ওজুহাতে সে সকলের নিকট সেলামী আদায় করে। সেলামী না দিলে হয়তো কোনদিন বাঁটুলের হাতেই প্ৰাণটা যাইবে এই ভয়ে সকলেই সেলামী দিত।

সেলামীর জুলুম সত্ত্বেও ব্যোমকেশের সহিত বাঁটুলের বিশেষ সম্ভাব জগিয়েছিল। আদায়তসিল উপলক্ষে বাঁটুল আসিয়া উপস্থিত হইলে ব্যোমকেশ তাহাকে চা সিগারেট দিত‌, তাহার সহিত গল্প জমাইত; শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষের কূটনীতি সম্বন্ধে অনেক খবর পাওয়া যাইত। বাঁটুল এই ফাঁকে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসঙ্গ তুলিত। যুদ্ধের পর মার্কিন সৈনিকেরা অনেক আগ্নেয়াস্ত্ৰ জলের দরে বিক্রি করিয়া চলিয়া গিয়াছিল‌, বাঁটুল সেই অস্ত্ৰ কিছু সংগ্ৰহ করিয়া রাখিয়াছিল‌, এখন সে তাহা আমাদের বিক্রি করিবার চেষ্টা করিত। বলিত‌, ‘একটা রাইফেল কিনে ঘরে রাখুন কতা। আমরা তো আর সব সময় সব দিকে নজর রাখতে পারি না। ডামাডোলের সময় হাতে হাতিয়ার থাকা ভাল।’

আমি বলিতাম‌, না‌, বাঁটুল‌, রাইফেল দরকার নেই। অত বড় জিনিস লুকিয়ে রাখা যাবে না‌, কোন দিন পুলিস খবর পাবে আর হাতে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবে। তার চেয়ে একটা পিস্তল কি রিভলবার যদি যোগাড় করতে পার–’

বাঁটুল বলিত‌, ‘পিস্তল যোগাড় করাই শক্ত বাবু। আচ্ছা‌, চেষ্টা করে দেখব—’

বাঁটুল মাসে একবার আসিত।

সেদিন যথারীতি সেলামী লইয়া বাঁটুল আমাদের অভয় প্রদানপূর্বক প্রস্থান করিলে আমরা কিছুক্ষণ ত্ৰিয়মাণাভাবে সাময়িক পরিস্থিতির পযালোচনা করিলাম। এভাবে আর কতদিন চলিবে? মাথার উপর খাঁড়া ঝুলাইয়া কতকাল বসিয়া থাকা যায়? স্বাধীনতা হয়তো আসিতেছে‌, কিন্তু তাহা ভোগ করিবার জন্য বাঁচিয়া থাকিব কি? সম্মুখ সমরে যদি বা প্ৰাণ বাঁচে্‌্‌, কাঁকর ও তেঁতুল বিচির গুড়া খাইয়া কত দিন বাঁচিব? ব্যোমকেশের হাতে কাজকর্ম কোনও কালেই বেশি থাকে না‌, এখন একেবারে বন্ধ হইয়াছে। যেখানে প্ৰকাশ্য হত্যার পাইকারি কারবার চলিতেছে‌, সেখানে ব্যোমকেশের রহস্যভেদী বুদ্ধি কাহার কাজে লাগিবে?

আমি বলিলাম‌, ‘ভারতীরে ছেড়ে ধর এইবিলা লক্ষ্মীর উপাসনা।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ রাত দুপুরে ছোরা বগলে নিয়ে বেরোও‌, যদি দু’চারটে কালাবাজারের মক্কেলকে সাবাড়। করতে পোর‌, তাহলে আর ভাবতে হবে না। যে সময়-কাল পড়েছে‌, বাঁটুল সদোরই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘কথাটা মন্দ বলোনি‌, যুগধর্মই ধর্ম। কিন্তু কি জানো‌, ও জিনিসটা রক্তে থাকা চাই। খুনই বল আর কালাবাজারই বল‌, পূর্বপুরুষদের রক্তের জোর না থাকলে হয় না। আমার বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার‌, স্কুলে অঙ্ক শেখাতেন আর বাড়িতে সাংখ্য পড়তেন। মা ছিলেন। বৈষ্ণব বংশের মেয়ে‌, নন্দগোপাল নিয়েই থাকতেন। সুতরাং ওসব আমার কম নয়।’

0 Shares