আদিম রিপু

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল‌, ‘ওকথা পরে হবে। আগে আমার একটা কথার জবাব দিন আমাকে আপনি চিনলেন কি করে? ঠিকানা পেলেন কোত্থেকে?’

কেষ্টবাবু কিছুক্ষণ জবুথবু হইয়া বসিয়া রহিলেন‌, তাঁহার ভাবভঙ্গীতে একটু ভিজা-বিড়াল ভাব প্রকাশ পাইল। অবশেষে তিনি জড়িত স্বরে বলিলেন‌, ‘সেদিন আপনারা আমাদের বাসায় গিছলেন‌, আপনাদের দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই আপনারা যখন‌, ফিরে চললেন তখন আমি আপনাদের পিছু নিয়েছিলাম। এখানে এসে নীচের হোটেলে আপনার পরিচয় পেলাম।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্থির নেত্রে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘হুঁ, আপনি দেখছি ভারি হুঁশিয়ার লোক। অনাদি হালদারের কাঁধে চেপে থাকেন কেন?’

কেষ্টবাবু বলিলেন‌, ‘আমি অনাদির ছেলেবেলার বন্ধু–দুরবস্থায় পড়েছি—তাই–’

‘তাই অনাদি হালদার আপনাকে খেতে পরতে দিচ্ছিল‌, এমন কি মদের পয়সা পর্যন্ত যোগাচ্ছিল। খুব গাঢ় বন্ধুত্ব বলতে হবে। —যাক‌, এবার আজকের ঘটনা বলুন। গোড়া থেকে বলুন।’

কেষ্টবাবু অপালক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন‌, তারপর ঈষৎ করুণ স্বরে বলিলেন‌, ‘আপনি দেখছি সবই জানেন। কিন্তু সত্যি বলছি আমি অনাদিকে খুন করিনি। আজ বিকেলবেলা-মানে কাল বিকেলবেলা অনাদির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। আমি বলেছিলুম‌, আজ কালীপুজো্‌্‌, আজ আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। অনাদি আমাকে দশটা টাকা দিয়ে বলেছিল–এই নিয়ে বেরিয়ে যাও‌, আর আমার বাড়িতে মাথা গলিও না।’

‘কে কে আপনাদের ঝগড়া শুনেছিল?’

‘বাড়িতে ননীবালা আর ন্যাপা ছিল। নীচের তলার ষষ্ঠীবাবুও ঝগড়া শুনেছিল। বারান্দায় বসে তামাক খাচ্ছিল‌, আমি নেমে আসতে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল-মাথার ওপর দিনরাত শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ চলেছে—কবে যে পাপ বিদেয় হবে জানি না।’

‘তারপর বলুন।’

‘তারপর রাত্ৰি আন্দাজ একটার সময় আমি ফিরে এলাম। এসে দেখি–’

‘রাত্রি একটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’

‘আপনার কাছে লুকোব না‌, শুড়ির দোকানে বসে মদ খেয়েছিলাম—জুয়ার আড্ডায় জুয়া খেলে তিরিশ টাকা জিতেছিলাম—তারপর একটু এদিক ওদিক—‘

‘হুঁ। বাসায় ফিরে কী দেখলেন?’

‘বাসায় ফিরে প্রথমেই দেখি নীচের তলায় ষষ্ঠীবাবুইকো হাতে সিঁড়ির ঘরে পায়চারি করছে। আমাকে দেখে বলে উঠল-ধম্মের কল বাতাসে নড়ে। কিছু বুঝতে পারলাম না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি-সিঁড়ির দরজা ভাঙা!

‘ঘরে ঢুকে দেখলাম বেঞ্চির ওপর প্রভাত আর ন্যাপা বসে আছে‌, ননীবালা দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝোয় বসেছে। আমাকে দেখে তিনজনে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল‌, যেন আগে কখনও দেখেনি। আমি তো অবাক। বললাম-একি‌, তোমরা বসে আছ কেন? কারুর মুখে কথা নেই। তারপর ন্যাপা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল—কেষ্টবাবু্‌, এ আপনার কাজ। আপনি কর্তাকে খুন করেছেন।

‘খুন! আমার তো মাথা ঘুরে গেল। জিজ্ঞেস করলাম-কে? কোথায়? কেন? কেউ উত্তর দিল না। শেষে প্রভাত বলল-ঐ ব্যালকনিতে গিয়ে দেখুন।

‘রাস্তার ধারের ব্যালকনিতে উঁকি মারলাম। অনাদি পড়ে আছে‌, রক্তারক্তি কাণ্ড। বুকে বন্দুকের গুলি লেগেছে। দেখে আমার ভিমি যাওয়ার মত অবস্থা‌, মেঝোয় বসে পড়লাম। মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যেতে লাগল।

‘তারপর কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। ওরা তিনজনে চাপা গলায় কথা কইছে‌, কি করা উচিত। তাই নিয়ে তর্ক করছে। ওদের কথা থেকে বুঝতে পারলাম‌, সন্ধ্যের পর ওরা কেউ বাড়ি ছিল না‌, এক অনাদি বাড়িতে ছিল। রাত্ৰি বারোটা নাগাদ ওরা ফিরে এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাড়া পেল না। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাব্ধির পর ওদের ভয় হল‌, হয়তো কিছু ঘটেছে। ওরা তখন দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে দেখল ব্যালকনিতে অনাদি মরে পড়ে আছে।

‘আমার মাথাটা একটু পরিষ্কার হলে আমি বললাম-তোমরা আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন-আমি অনাদিকে খুন করব কেন? অনাদি আমার অন্নদাতা বন্ধু—। ন্যাপা লাফিয়ে উঠে বলল—ন্যাকামি করবেন না। আমি যাচ্ছি পুলিসে খবর দিতে। এই বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

‘আমার ভয় হল। পুলিস এসে আমাকেই ধরবে। ওরা সাক্ষী দেবে আমার সঙ্গে অনাদির ঝগড়া হয়েছিল। আমি আর সেখানে থাকতে পারলাম না‌, উঠে পালিয়ে এলাম। কোথায় যাব। কিছুই জানি না; রাস্তায় নেমে আপনার কথা মনে পড়ল।’—

কিছুক্ষণ কথা হইল না‌, কেষ্টবাবু যেন বিমাইয়া পড়িলেন। কিন্তু লক্ষ্য করিলাম বিমানোর মধ্যে তাঁহার অর্ধনিমীলিত চক্ষু দু’টি বারবার ব্যোমকেশের মুখের উপর যাতায়াত করিতেছে।

ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল‌, ‘আপনি তাহলে অনাদি হালদারকে খুন করেননি।’

কেষ্টবাবু চমকিয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিলেন‌, ‘অ্যাঁ! না‌, ব্যোমকেশবাবু্‌, আমি খুন করিনি। আপনিই ভেবে দেখুন‌, অন্যদিকে খুন করে আমার লাভ কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনাদি হালদার আপনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।’

কেষ্টবাবু বলিলেন‌, ‘সে ওর মুখের কথা‌, রাগের মুখে বলেছিল। আমাকে সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দেবার সাহস অনাদির ছিল না।’

‘সাহস ছিল না! অর্থাৎ আপনি অনাদি হালদারের জীবনের কোনও গুরুতর গুপ্তকথা জানেন।’

কেষ্টবাবু কিছুক্ষণ নীরব রহিলেন‌, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন‌, ‘অনাদির সব গুপ্তকথা আমি জানি‌, তাকে আমি ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারতাম। কিন্তু ওকথা এখন থাক‌, যদি দরকার হয় পরে কলাব‌, ব্যোমকেশবাবু। এখন আমাকে পুলিসের হাত থেকে বাঁচাবার একটা ব্যবস্থা করুন।’

ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে যদি বাঁচাতে হয় তাহলে কে সত্যি খুন করেছে সেটা জানা দরকার। ঘটনাস্থলে যেতে হবে।’

0 Shares