আদিম রিপু

কেষ্টবাবু শঙ্কিত হইলেন‌, স্খলিতস্বরে বলিলেন‌, ‘আমাকেও যেতে হবে?’

‘তা যেতে হবে বৈকি। আপনি না গেলে আমি কোন সূত্রে যাব?’

‘কিন্তু‌, সেখানে পুলিস বোধহয় এতক্ষণ এসে পড়েছে—’

ব্যোমকেশ কড়া সুরে বলিল‌, ‘আপনি যদি খুন না করে থাকেন আপনার ভয়টা কিসের?–অজিত‌, তৈরি হয়ে নাও‌, আমরা তিনজনেই যাব।’

কেষ্টবাবু বিহ্বলভাবে বসিয়া রহিলেন‌, আমরা বেশবাস পরিধান করিয়া তৈয়ার হইলাম। বসিবার ঘরে ফিরিয়া আইলে কেষ্টবাবু চেয়ার হইতে কষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনার বাড়িতে একটু-হে হে‌, মদ পাওয়া যাবে? একটু হুইস্কি কিম্বা ব্র্যান্ডি‌, হাতে পায়ে যেন বল পাচ্ছি না।’

ব্যোমকেশ বিরক্ত হইয়া বলিল‌, ‘আমি বাড়িতে মদ রাখি না। আসুন।’

অনাদি হালদারের বাসায় যখন পৌঁছিলাম‌, তখন রাত্রি সাড়ে চারটা। কলিকাতা শহর দুপুর রাত্রি পর্যন্ত মাতামাতি করিয়া শেষ রাত্রির গভীর ঘুম ঘুমাইতেছে।

নীচের তলায় সদর দরজা খোলা। সিঁড়ির ঘরে কেহ নাই। ষষ্ঠীবাবু বোধ করি ক্লান্ত হইয়া শুইতে গিয়াছেন। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া দেখিলাম‌, দরজার হুড়ক ভাঙা; কবাট ভাঙে নাই‌, ভুঞ্জ ক্লডিয়া একদিকে ছিটকাইয়া পডিয়াছে। আমরা ব্যোমকেশকে অগ্ৰে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলাম।

আমরা প্রবেশ করিতেই ঘরে ঘোন একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। ঘরে কিন্তু মাত্র তিনটি লোক ছিল; ননীবালা‌, প্ৰভাত ও ন্যাপা। তাহারা একসঙ্গে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। ন্যাপা বলিয়া উঠিল‌, ‘কে? কে? কি চাই? বলিয়াই আমাদের পশ্চাতে কেষ্টবাবুকে দেখিয়া থামিয়া গেল। ননীবালা থলথলে মুখে প্ৰকাণ্ড হ্যাঁ করিয়া নিজের অজ্ঞাতসারেই উচ্চকণ্ঠে স্বগতোক্তি করিলেন‌, ‘অ্যাঁ‌, ব্যোমকেশবাবু।’ তিনি আমাদের দেখিয়া বিশেষ আহ্বাদিত হইয়াছেন মনে হইল না। প্রভাত বুদ্ধিহীনের মত চাহিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া ননীবালার উদ্দেশে বলিল, ‘কেষ্টবাবু আমাকে ডেকে এনেছেন। পুলিস এখনও আসেনি?’

ননীবালা মাথা নাড়িলেন। ব্যোমকেশ ন্যাপার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে বিহ্বলভাবে বলিয়া উঠিল‌, ‘আপনি–ব্যোমকেশবাবু্‌, মানে–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ। ইনি আমার বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন আমরা এসেছিলাম মনে আছে বোধহয়। আপনি পুলিস ডাকতে গিয়েছিলেন না? কী হ’ল?’

ন্যাপা কেমন যেন বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিল‌, চমকিয়া উঠিয়া বলিল‌, ‘পুলিস-হ্যাঁ‌, থানায় গিয়েছিলাম। থানায় কেউ ছিল না‌, একটা জমাদার টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার কথা শুনে রেগে উঠল‌, বললে‌, যাও যাও‌, একটা হিন্দু মরেছে তার আবার এত হৈ-চৈ কিসের। লাশ রাস্তায় ফেলে দাওগে। আমি চলে আসছিলাম‌, তখন আমাকে ডেকে বললে—ঠিকানা রেখে যাও‌, সকালবেলা দারোগা সাহেব এলে জানাবো। আমি অনাদিবাবুর নাম আর ঠিকানা দিয়ে চলে এলাম।’

ক্ষেত্রবিশেষে পুলিসের অবজ্ঞাপূর্ণ নির্লিপ্ততা এবং ক্ষেত্রান্তরে অতিরিক্ত কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে কোনও নূতনত্ব ছিল না; বস্তুত অভ্যাসবিশেই আশা করিয়ছিলাম যে‌, পুলিস সংবাদ পাইবামাত্র ছুটিয়া আসিবে। ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল‌, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘কেষ্টবাবুকে আপনারা অনাদিবাবুর হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে এই ব্যাপারের তদন্তু করতে চাই। কারুর আপত্তি আছে?’

কেহ উত্তর দিল না‌, ব্যোমকেশের চক্ষু এড়াইয়া এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। তখন ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘লাশ ব্যালকনিতে আছে‌, আপনারা কেউ ছুঁয়েছেন কি?’

সকলে মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিল।

আমরা তখন ব্যালকনিতে প্ৰবেশ করিলাম। দেয়ালের গায়ে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলিতেছিল, তাহার নির্নিমেষ আলোতে দেখিলাম অনাদি হালদারের মৃতদেহ কাত হইয়া মেঝের উপর পড়িয়া আছে‌, মুখ রাস্তার দিকে। গায়ে শাদা রঙের গরম গেঞ্জি‌, তাহার উপর বালাপোশ। বুকের উপর হইতে বালাপোশ সরিয়া গিয়েছে‌, গেঞ্জিতে একটি ছিদ্র; সেই ছিদ্রপথে গাঢ় রক্ত নিৰ্গত হইয়া মাটিতে গড়াইয়া পড়িয়াছে। মৃতের মুখের উপর পৈশাচিক হাসির মত একটা বিকৃতি জমাট বধিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশ নত হইয়া পিঠের দিক হইতে বালাপোশ সরাইয়া দিল। দেখিলাম। এদিকেও গেঞ্জির উপর একটি সুগোল ছিদ্র। এদিকে রক্ত বেশি গড়ায় নাই‌, কেবল ছিদ্রের চারিদিকে ভিজিয়া উঠিয়াছে। বন্দুকের গুলি দেহ ভেদ করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।

মৃতদেহ ছাড়িয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, অন্যমনস্কভাবে বাহিরে রাস্তার দিকে তাকাইয়া রহিল। আমি হ্রস্বকণ্ঠে প্রশ্ন করিলাম‌, ‘কি মনে হচ্ছে?’

ব্যোমকেশ অন্যমনে বলিল, ‘এই লোকটাই সেদিন আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল, আশ্চর্য নয়?…মৃতদেহ শক্ত হতে আরম্ভ করেছে…..বোধহয় অনাদি হালদার রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে রাস্তায় বাজি পোড়ানো দেখছিল–’ ব্যোমকেশ রাস্তার পরপারে বড় বাড়িটার দিকে তাকাইল‌, ‘কিন্তু গুলিটা গেল কোথায়? শরীরের মধ্যে নেই‌, শরীর ফুড়ে বেরিয়ে গেছে—‘

ব্যোমকেশের অনুমান যদি সত্য হয় তাহা হইলে গুলিটা ব্যালকনির দেয়ালে বিঁধিয়া থাকিবার কথা। কিন্তু ব্যালকনির দেয়াল ছাদ মেঝে কোথাও গুলি বা গুলির দাগ দেখিতে পাইলাম না। বন্দুকের গুলি ভেদ করিয়া বাহির হইবার সময় কখনও কখনও তেরছা পথে বাহির হয়; কিম্বা অনাদি হালদার হয়তো তেরছাভাবে দাঁড়াইয়া ছিল‌, গুলি ব্যালকনির পাশের ফাঁক দিয়া বাহিরে। চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু লাশ যেভাবে পড়িয়া আছে‌, তাহাতে মনে হয়‌, অনাদি হালদার রাস্তার দিকে সুমুখ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল‌, বুকে গুলি খাইয়া সেইখানেই বসিয়া পড়িয়াছে‌, তারপর পাশের দিকে ঢলিয়া পড়িয়াছে।

0 Shares