সামনে রাস্তার ওপারে ওই বাড়িটা। মাঝে ৭০/৮০ ফুটের ব্যবধান। হয়তো ওই বাড়ির দ্বিতল বা ত্রিতলের কোনও জানালা হইতে গুলি আসিয়াছে।
ব্যালকনিতে গুলির কোনও চিহ্ন না পাইয়া ব্যোমকেশ আর একবার নত হইয়া মৃতদেহ পরীক্ষা করিল। বালাপোশ সরাইয়া লইলে দেখিলাম, নিম্নাঙ্গে ধুতির কষি আলগা হইয়া গিয়াছে, কোমরে ঘুন্সির মত একটি মোটা কালো সুতা দেখা যাইতেছে। ঘুন্সিতে ফাঁস লাগানো একটি চাবি। ব্যোমকেশ চাবিটি নাড়াচাড়া করিয়া দেখিল, তারপর সন্তৰ্পণে খুলিয়া লইয়া মৃতদেহের উপর আবার বাল্যাপোশ ঢাকা দিয়া বলিল, ‘চল, দেখা হয়েছে।’
বাহিরে তখনও রাত্রির অন্ধকার কাটে নাই। রাস্তা দিয়া শাকসব্জি বোঝাই লরি চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কলিকাতা শহরের বিরাট ক্ষুধা মিটাইবার আয়োজন চলিতেছে।
ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম, যে চারিজন লোক ঘরের মধ্যে ছিল তাহারা আগের মতাই দাঁড়াইয়া আছে, কেহ নড়ে নাই। ব্যোমকেশ হাতের চাবি দেখাইয়া বলিল, ‘মৃতদেহের কোমরে ছিল। কোথাকার চাবি?’
একে একে চারিজনের মুখ দেখিলাম। সকলেই একদৃষ্টি চাবির পানে চাহিয়া আছে, কেবল ন্যাপার মুখে ভয়ের ছায়া। অবশেষে ননীবালা বলিলেন, ‘অনাদিবাবুর শোবার ঘরে লোহার আলমারি আছে, তারই চাবি।’
‘লোহার আলমারিতে কি আছে? টাকাকড়ি?’
সকলেই মাথা নাড়িল, কেহ জানে না। ননীবালা বলিলেন, ‘কি করে জানব। অনাদিবাবুকি কাউকে আলমারি ছুঁতে দিত? কাছে গেলেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠত—’ প্ৰভাতের চোখের দিকে চাহিয়া ননীবালা থামিয়া গেলেন।
ন্যাপা অধর লেহন করিয়া বলিল, ‘আলমারিতে টাকাকড়ি বোধহয় থাকত না; কত ব্যাঙ্কে টুটক রাখতেন।’
ব্যোমকেশ চাবি পকেটে রাখিয়া বলিল, ‘আলমারিতে কি আছে। পরে দেখা যাবে। এখন আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।–বাড়িতে ঢোকবার বেরুবার রাস্তা কটা?
সকলে ভাঙা দ্বারের দিকে নির্দেশ করিল, ‘মাত্র ওই একটা।’
‘অন্য দরজা নেই?’
না।
ব্যোমকেশ বেঞ্চির একপাশে বসিয়া বলিল, ‘বেশ। তার মানে অনাদিবাবুর যখন মৃত্যু হয়। তখন বাড়িতে কেহ ছিল না, বাইরে থেকে গুলি এসেছে। প্রভাতবাবু্, আপনি বলুন দেখি, আপনি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?’
প্রভাত মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া কিছুক্ষণ তাহার অগোছালো চুলে হাত বুলাইল, তারপর চোখ তুলিয়া বলিল, ‘আমি মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম আন্দাজ সাড়ে আটটার সময়।’
‘ও, আপনারা দু’জনে একসঙ্গে বেরিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, মা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।’
‘তাই নাকি?’ বলিয়া ব্যোমকেশ ননীবালার পানে চাহিল।
ননীবালা বলিলেন, ‘আমার তো আর সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে না, নামাসে ছাঁ মাসে একবার। কাল ঐ যে কি বলে শেয়ালদার কাছে সিনেমা আছে সেখানে ‘জয় মা কালী’ দেখাচ্ছিল, তাই দেখতে গিছালুম। এ বাড়ির রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়া আটটার মধ্যেই চুকে যায়, তাই রাত্তিরের শোতে গিয়েছিলুম। প্রভাত বলল—’
রূপে তাঁহাকে থামাইয়া দিয়া বলিল, আপনার যখন বেরিয়েছিলেন তখন বাড়িতে কে কে ছিল?’
প্রভাত বলিল, ‘কেবল অনাদিবাবু ছিলেন। নৃপেনবাবু আটটার পরই বেরিয়ে গিয়েছিলেন।’ ব্যোমকেশ ন্যাপার দিকে ফিরিল, কিন্তু কোথায় ন্যাপা। সে এতক্ষণ ভিতর দিকের একটা দরজার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, কখন অলক্ষিতে অন্তর্হিত হইয়াছে।
ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ননীবালার দিকে ফিরিয়া হাত উল্টাইয়া প্রশ্ন করিল, ননীবালা অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া নীরবে দেখাইয়া দিলেন-ন্যাপা ওই দ্বারা দিয়াই অন্তহিত হইয়াছে। ব্যোমকেশ তখন বিড়াল-পদক্ষেপে সেই দিকে চলিল; আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম।
খানিকটা সরু গলির মত, তারপর একটা ঘর। আলো জ্বলিতেছে। আমরা উঁকি মারিয়া দেখিলাম, ঘরের এক কোণে একটা টেবিলের দেরাজ খুলিয়া ন্যাপা ভিতরে হাত ঢুকাইয়া দিয়াছে এবং অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে কিছু খুঁজতেছে। আমাদের দ্বারের কাছে দেখিয়া সে তড়িদ্বেগে খাড়া হইল এবং দেরাজ বন্ধ করিয়া দিল।
আমরা প্ৰবেশ করিলাম। ব্যোমকেশ অপ্ৰসন্ন স্বরে বলিল, ‘এটা আপনার ঘর?’
ন্যাপা কিছুক্ষণ বোকার মত চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, আমার ঘর।’
‘আপনি না বলে চলে এলেন কেন? কি করছেন?’
ন্যাপা পাংশুমুখে হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘কিছু না-এই-একটা সিগারেট খাব বলে ঘরে এসেছিলাম–তা খুঁজে পাচ্ছি না-?
খুঁজিয়া না পাওয়ার কথা নয়, সিগারেটের প্যাকেট টেবিলের এক কোণে রাখা রহিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা কি? সিগারেটের প্যাকেট বলেই মনে হচ্ছে।’
ন্যাপা যেন অতিকাইয়া উঠিল–’অ্যাঁ–! ও-হাঁ-দেশলাই-দেশলাই খুঁজে পাচ্ছি না-’
ব্যোমকেশ একবার তাহকে ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়া নিজের পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া দিলে–’এই নিন।’ ন্যাপা কম্পিত হস্তে দেশলাই জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইল।
আমি ঘরের চারিদিকে একবার তাকাইলাম। ক্ষুদ্র ঘর, আসবাবের মধ্যে তক্তপোশের উপর বিছানা, একটি দেরাজযুক্ত টেবিল ও তৎসংলগ্ন চেয়ার। ঘরে একটি গরাদ লাগানো জানালা আছে।
জানালাটা খোলা রহিয়াছে। ব্যোমকেশ তাহার সামনে গিয়া দাঁড়াইল, আমিও গেলাম। আকাশ ফরসা হইয়া আসিতেছে। জানোলা দিয়া অর্ধ-সমাপ্ত নূতন বাড়িটা দেখা গেল। মাঝখানে গভীর খাদের মত গলি গিয়াছে।
‘নৃপেনবাবু্, আপনার বাড়ি কোথায়?’
ব্যোমকেশের এই আকস্মিক প্রশ্নে নৃপেন প্ৰায় লাফাইয়া উঠিল। সে টেবিলের কিনারায় ঠেস দিয়া সিগারেটে লম্বা টান দিতেছিল, বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া বলিল, ‘বাড়ি-?’