‘হ্যাঁ, দেশ। নিবাস কোথায়? কোন জেলায়?’
নৃপেন ভ্যাবাচাকা খাইয়া বলিল, ‘নিবাস? চব্বিশ পরগণা, ডায়মন্ডহারবার লাইনের খেজুরহাটে।’
ব্যোমকেশ জানালার দিক হইতে ফিরিয়া নৃপেনের পানে চাহিয়া রহিল, বলিল, ‘খেজুরহাট! আপনি খেজুরহাটের রমেশ মল্লিককে চেনেন?’
নৃপেন দগ্ধাবশেষ সিগারেট ফেলিয়া যেন ধূমরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘চিনি। আমাদের পাড়ায় থাকেন।’
‘খেজুরহাটে আপনার কে আছেন?’
‘খুড়ো।’
‘বাপ নেই?
‘না।’
‘ভাল কথা, আপনার পুরো নামটা কী?
‘নূপেন দত্ত।’
ব্যোমকেশ নৃপেনের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, একটু ঘনিষ্ঠতার সুরে বলিল, ‘নৃপেনবাবু্, আপনাকে দেখে কাজের লোক বলে মনে হয়। আপনি কতদিন অনাদিবাবুর সেক্রেটারির কাজ করছেন?’
নৃপেন একটু ভাবিয়া বলিল, ‘প্রায় চার বছর।’
‘চার বছর? এতদিন টিকে ছিলেন?’
নৃপেন চুপ করিয়া রহিল।
‘অনাদিবাবুর কেউ শত্রু ছিল। কিনা। আপনি নিশ্চয় জানেন?
নৃপেন অসহায় মুখ তুলিল, ‘কার নাম করব? যার সঙ্গে কর্তার পরিচয় ছিল তার সঙ্গেই শক্ৰতা ছিল। ঝগড়া করা ছিল ওঁর স্বভাব।’
‘বাড়ির সকলের সঙ্গেই ঝগড়া চলত?
‘সকলকেই উনি গালমন্দ করতেন। কিন্তু আমরা ওঁর অধীন, আমাদের চুপ করে থাকতে হত। কেবল কেষ্টবাবু মাঝে মাঝে–’
‘প্ৰভাতকে অনাদিবাবু গালমন্দ করতেন?
‘ঠিক গালমন্দ নয়, সুবিধে পেলেই খোঁচা দিতেন। প্রভাতবাবু কিন্তু গায়ে মাখতেন না।’
‘আচ্ছা, ওকথা থাক। বলুন দেখি কাল রাত্রে আপনি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?’
‘আটটার পরই বেরিয়েছিলাম।’
‘ফিরলেন। কখন?’
‘আন্দাজ একটায়। ফিরে দেখলাম, ননীবালা দেবী আর প্রভাতবাবু দোর ঠেলাঠেলি করছেন।’
‘আপনি আটটা থেকে একটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’
‘সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।’
‘আপনিও ‘জয় মা কালী দেখতে গিয়েছিলেন?’
‘না, আমি একটা ইংরিজি ছবি দেখতে গিছলাম।’
‘ও! অত রাত্রে ফিরলেন কি করে?’
‘হেঁটে।’
লক্ষ্য করলাম ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নৃপেন অনেকটা ধাতস্থ হইয়াছে, আগের মত ভীত বিচলিত ভাব আর নাই। ব্যোমকেশ বলিল, ‘চলুন, এবার ওঘরে যাওয়া যাক।’
৬
তিনজনে ওঘরে ফিরিয়া গিয়া দেখিলাম, কেষ্টবাবু এবং প্রভাত বেঞ্চির দুই কোণে উপবিষ্ট। কেষ্টবাবু হাই তুলিতেছেন এবং আড়চক্ষে প্রভাতকে নিরীক্ষণ করিতেছেন। প্রভাত করতলে চিবুক রাখিয়া চিন্তামগ্ন। ননীবালা মেঝোয় পা ছড়াইয়া দেয়ালে ঠেস দিয়া ঝিমাইয়া পড়িয়াছেন। আমাদের দেখিয়া সকলে সিধা হইলেন। প্রভাত বেঞ্চি ছাড়িয়া উঠিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, ‘বসুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বসব না। ভোর হয়ে এল, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। এখনি হয়তো পুলিস এসে পড়বে। আমাদের দেখলে পুলিসের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। আপনাদের একটা কথা বলে রাখি মনে রাখবেন। কারুর ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করবেন না, তাতে নিজেরই অনিষ্ট হবে, পুলিস হয়তো সকলকেই ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে পুরবে।’
সকলে চুপ করিয়া রহিল।
‘প্রভাতবাবু্, এবার আপনার কথা বলুন। কাল আপনি আপনার মাকে সিনেমায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, নিজে সিনেমা দেখেননি?’
প্ৰভাত বলিল, ‘না। আমি টিকিট কিনে মাকে সিনেমায় বসিয়ে দিয়ে নিজের দোকানে গিয়েছিলাম।’
‘ও। রাত্রি সাড়ে আটটার পর দোকানে গেলেন?’
‘হাঁ। দেয়ালির রাত্রে দোকান আলো দিয়ে সাজিয়েছিলাম।’
‘তারপর?
‘তারপর পেীনে বারোটার সময় দোকান বন্ধ করে আবার সিনেমায় গেলাম, সেখান থেকে মাকে নিয়ে ফিরে এলাম।’
মুছলমান্দাজ নটা থেকে পোনে বারোটা পর্যন্ত্র আপনি দোকানই ছিলেন। দোকানে আর কেউ ছিল?’
‘গুরুং ছিল, দোরের সামনে পাহারা দিচ্ছিল।’
‘গুরুং-মানে গুর্খা দরোয়ান। খদ্দের কেউ আসেননি?’
‘না।’
‘সারাক্ষণ দোকানে বসে কি করলেন?’
‘কিছু না। পিছনে কুঠরিতে বসে বই বাঁধলাম।’
‘আচ্ছা, ওকথা যাক।–অনাদিবাবুর সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?’
প্রভাত ক্ষুব্ধ চোখ তুলিল, ‘না। উনি আমাকে পুষ্যিপুতুর নিয়েছিলেন, প্রথম প্রথম ভাল ব্যবহার করতেন। তারপর–ক্রমশ—’
‘ক্রমশ ওঁর মন বদলে গেল? আচ্ছা, উনি আপনাকে পুষ্যপুত্তুর নিয়েছিলেন কেন?’
‘তা জানি না।’
‘প্ৰথম প্ৰথম ভাল ব্যবহার করতেন, তারপর মন-মেজাজ বদলে গেল; এর কোনও কারণ হয়েছিল কি?’
‘হয়তো হয়েছিল। আমি জ্ঞানত কোনও দোষ করিনি।’
প্রভাত ক্লান্তভাবে আবার বেঞ্চিতে বসিল। ব্যোমকেশ তাহাকে সদয়-চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘আপনি বরং কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন গিয়ে। পুলিস একবার এসে পড়লে আর বিশ্রাম পাবেন কি না সন্দেহ।’
প্ৰভাত কিন্তু কেবল মাথা নাড়িল। ব্যোমকেশ তখন ননীবালার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আপনার সঙ্গেও তো অনাদিবাবুর সদ্ভাব ছিল না।’
ননীবালা যুগপৎ মুখ এবং গো-চক্ষু ব্যাদিত করিয়া প্রায় কাঁদো-কাঁদো হইয়া উঠিলেন, ‘আপনাকে তো সবই বলেছি, ব্যোমকেশবাবু। আমি ছিলুম। বুড়োর চক্ষুশূল। প্রভাতকে বুড়ো ভালবাসত, কিন্তু আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না। রাতদিন ছুতো খুঁজে বেড়াতো; একটা কিছু পেলেই শুরু করে দিত দাঁতের বান্দ্যি। এমন নীচ অন্তঃকরণ–’ ননীবালা থামিয়া গেলেন। অনাদি হালদার মরিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার মৃতদেহ অদূরেই পড়িয়া আছে, এই কথা সহসা স্মরণ করিয়াই বোধ করি আত্মসংবরণ করিলেন। অধিকন্তু অনাদিবাবুর সহিত তাঁহার অসদ্ভাবের প্রসঙ্গ অপ্ৰকাশ থাকাই বাঞ্ছনীয়, তাহা কিঞ্চিৎ বিলম্বে উপলব্ধি করিলেন।
কেষ্টবাবুও সেই ইঙ্গিত করিলেন, হেঁচ্কি তোলার মত একটা হাসির শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘তাহলে শুধু আমার সঙ্গেই অনাদির ঝগড়া ছিল না!’