প্রভাত একবার ঘাড় ফিরাইয়া তাহার দিকে তাকাইল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ও কথার কোনও মানে হয় না। দেখা যাচ্ছে সকলের সঙ্গেই অনাদি হালদারের ঝগড়া ছিল; তাতে কিছু প্ৰমাণ হয় না। খুন করতে হলে যেমন খুন করার ইচ্ছে থাকা চাই, তেমনি খুন করার সুযোগও দরকার।’ ব্যোমকেশ ননীবালার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘কাল সিনেমা কেমন দেখলেন?’
ননীবালা আবার হা করিয়া চাহিলেন।
‘অ্যাঁ–সিনেমা–!’
‘ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখেছিলেন?’
এতক্ষণে ননীবালা বোধহয় প্রশ্নের মমর্থ অনুধান করিলেন, বলিলেন, ‘ওমা, তা আবার দেখিনি! গোড়া থেকে শেষ অবধি দেখেছি, ছবি শেষ হয়েছে। তবে বাইরে এসেছি। আমিও বাইরে এসে দাঁড়ালাম, আর প্রভাত এল। ওর সঙ্গে বাসায় চলে এলুম। এসে দেখি—’
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘জানি। এবার চলুন, অনাদি হালদারের শোবার ঘরে যাওয়া যাক। লোহার আলমারিটা দেখা দরকার।’
আমরা ছয়জন একজোট হইয়া অনাদি হালদারের শয়নকক্ষের দিকে চলিলাম। কয়েকদিন আগে যে ঘরে অনাদি হালদারের সহিত দেখা হইয়াছিল, তাহারই পাশের ঘর। নৃপেন দ্বারের পাশে সুইচ টিপিয়া আলো জ্বলিয়া দিল।
ঘরটি আকারে প্রকারে নৃপেনের ঘরের মতই, তবে বাড়ির অন্য প্রান্তে। একটি গরাদযুক্ত জানালা খোলা রহিয়াছে। ঘরে একটি খাট এবং তাহার শিয়রে একটি স্টীলের আলমারি ছাড়া আর কিছু নাই।
আমরা সকলে ঘরে প্রবেশ করিলে ঘরে স্থানাভাব ঘটিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাদের সকলকে এ-ঘরে দরকার নেই। কেষ্টবাবু্, আপনি বরং ও-ঘরে থাকুন গিয়ে। সিঁড়ির দরজা ভাঙা, এখুনি হয়তো পুলিস এসে পড়বে।’
আলমারির ভিতর কি আছে, তাহা জানিবার কৌতুহল অন্যান্য সকলের মত কেষ্টবাবুরও নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তিনি বলিলেন, ‘কুছ পরোয়া নেই, আমিই মড়া আগলাবো। কিন্তু, এই সময় অন্তত এক পেয়ালা গরম চা পাওয়া যেত।’ বলিয়া তিনি সম্পৃহভাবে হাত ঘষিতে লাগিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, চা হলে মন্দ হত না, সে ননীবালার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি ফিরাইল।
ননীবালা অনিচ্ছাভরে বলিলেন, ‘চা আমি করতে পারি। কিন্তু দুধ নেই যে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দুধের বদলে লেবুর রস চলতে পারে।’
কেষ্টবাবু গাঢ়স্বরে বলিলেন, ‘আদা! আদা! আদার রস দিয়ে চা খান, শরীর চাঙ্গা হবে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আদার রসও চলবে।’
ননীবালা ও কোষ্ট্রবাবু প্ৰস্থান করিলে নৃপেন একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘আমাকে দরকার হবে কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকেই দরকার। প্রভাতবাবু বরং নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করতে পারেন।’
প্রভাত একবার যেন দ্বিধা করিল, তারপর কোনও কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। ঘরে রহিলাম আমরা দু’জন ও নৃপেন।
ঘরে বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু নাই। খাটের উপর বিছানা পাতা; পরিষ্কার বিছানা, গত রাত্রে ব্যবহৃত হয় নাই। দেয়ালে আলনায় একটি কাচা ধুতি পাকানো রহিয়াছে। এক কোণে গেলাস-ঢাকা জলের কুঁজা। ব্যোমকেশ এদিকে ওদিকে দৃষ্টি বুলাইয়া পকেট হইতে চাবি বাহির করিল।
আলমারিটা নূতন। বার্নিশ করা কাঠের মত রঙ, লম্বা সরু আকৃতি, অত্যন্ত মজবুত। ব্যোমকেশ চাবি ঘুরাইয়া জোড়া কবাট খুলিয়া ফেলিল। আমি এবং নৃপেন সাগ্রহে ভিতরে উঁকি মারিলাম।
ভিতরে চারিটি থাক। সবেচি থাকের এক প্ৰান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এক সারি বই; মাঝে মাঝে ভাঙা দাঁতের মত ফাঁক পড়িয়াছে। কয়েকটি বইয়ের পিঠে সোনার জলে নাম লেখা,
অধিকাংশই বটতলার বই, কিন্তু বাঁধাই ভাল। হয়তো প্ৰভাত বাঁধিয়া দিয়াছে।
ব্যোমকেশ নৃপেনকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘অনাদি হালদার কি খুব বই পড়ত?’
নৃপেন শুষ্কস্বরে বলিল, ‘কোন দিন পড়তে দেখিনি।’
‘বাড়িতে আর কেউ বই পড়ে?’
‘প্রভাতবাবু পড়েন। আমিও পেলে পড়ি। কিন্তু কর্তার আলমারিতে যে বই আছে, তা আমি কখনও চোখে দেখিনি।’
‘অথচ বইয়ের সারিতে ফাঁক দেখে মনে হচ্ছে কয়েকখানা বই বার করা হয়েছে। কোথায় গেল বইগুলো?’
নৃপেন ঘরের এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘তা তো বলতে পারি না। এ-ঘরে দেখছি না। প্রভাতবাবুকে জিজ্ঞেস করব?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখন থাক, এমন কিছু জরুরী কথা নয়।–আচ্ছা, বাইরে অনাদি হালদারের কোথায় বেশি যাতায়াত ছিল?’
নৃপেন বলিল, ‘কত বাড়ি থেকে বড় একটা বেরুতেন না। যখন বেরুতেন, হয় সলিসিটারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, নয়তো ব্যাঙ্কে যেতেন। এ ছাড়া আর বড় কোথাও যাতায়াত ছিল না।’
ব্যোমকেশ দ্বিতীয় থাকের প্রতি দৃষ্টি নামাইল।
দ্বিতীয় থাকে অনেকগুলি শিশিী-বোতল রহিয়াছে। শিশিগুলি পেটেন্ট ঔষধের, বোতলগুলি বিলাতি মদ্যের। একটি বোতলের মদ্য প্রায় তলায় গিয়া ঠেকিয়াছে, অন্যগুলি সীল করা।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনাদি হালদার মদ খেত?’
নৃপেন বলিল, ‘মাতাল ছিলেন না। তবে খেতেন। মাঝে মধ্যে গন্ধ পেয়েছি।’
ঔষধের শিশিগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল অধিকাংশই টনিক জাতীয় ঔষধ্্, অতীত যৌবনকে পুনরুদ্ধার করিবার বিলাতি মুষ্টিযোগ। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘সন্ধের পর বেড়াতে বেরুনোর অভ্যোস অনাদি হালদারের ছিল না?’
নৃপেন বলিল, ‘খুব বেশি নয়, মাসে দু’-তিন দিন বেরুতেন।’
‘বাঃ! অনাদি হালদারের গোটা চরিত্রটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খাসা চরিত্র!’ ব্যোমকেশ আলমারির তৃতীয় থাকে মন দিল।
তৃতীয় থাকে অনেকগুলি মোটা মোটা খাতা এবং কয়েকটি ফাইল। খাতাগুলি কার্ডবোর্ড দিয়া মজবুত করিয়া বাঁধানো। খুলিয়া দেখা গেল ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাবের খাতা। ব্যবসায়ের রীতি প্রকৃতি জানিতে হইলে খাতাগুলি ভাল করিয়া অধ্যয়ন করা প্রয়োজন; কিন্তু তাহার সময় নাই। ব্যোমকেশ নৃপেনকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘অনাদি হালদার কিসের ব্যবসা করত। আপনি জানেন?’