নৃপেন বলিল, ‘আগে কি ব্যবসা করতেন জানি না, উনি নিজের কথা কাউকে বলতেন না। তবে যুদ্ধের গোড়ার দিকে জাপানী মাল কিনেছিলেন। কটন মিলে যেসব কলকন্তুজা লাগে, তাই। সস্তায় কিনেছিলেন–’
‘তারপর কালাবাজারের দরে বিক্রি করেছিলেন। বুঝেছি।’ ব্যোমকেশ একখানা ফাইল তুলিয়া লইয়া মলাট খুলিয়া ধরিল।
ফাইলে নানা জাতীয় দলিলপত্র রহিয়াছে। নূতন বাড়ির ইষ্টম্বর দস্তাবেজ, সলিসিটারের চিঠি, বাড়িভাড়ার রসিদ, ইত্যাদি। কাগজপত্রের উপর লঘুভাবে চোখ বুলাইতে বুলাইতে ব্যোমকেশ পাতা উল্টাইতে লাগিল, তারপর এক জায়গায় আসিয়া থামিল। একটি রুলটানা কাগজে কয়েক ছত্র লেখা, নীচে স্ট্যাম্পের উপর দস্তখত।
কাগজখানা ব্যোমকেশ ফাইল হইতে বাহির করিয়া লইল, মুখের কাছে তুলিয়া মনোযোগ সহকারে পড়িতে লাগিল। আমি গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, একটি হ্যান্ডনেট। অনাদি হালদার হাতচিঠির উপর দয়ালহরি মজুমদার নামক এক ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিয়াছে।
ব্যোমকেশ হ্যান্ডনেট হইতে মুখ তুলিয়া বলিল, ‘দয়ালহরি মজুমদার কে?’
নৃপেন কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘দয়ালহরি-ও, মনে পড়েছে–একটু কাছে সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘দয়ালহরিবাবুর মেয়েকে প্রভাতবাবু বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তারপর কর্তা মেয়ে দেখে অপছন্দ করেন–’
‘মেয়ে বুঝি কুচ্ছিৎ?’
‘আমরা কেউ দেখিনি।’
‘কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা ধার দেওয়ার মানে কি?’
‘জানি না; হয়তো ওই জন্যেই–’
‘ওই জন্যে কী?’
‘হয়তো, যাকে টাকা ধার দিয়েছেন, তার মেয়ের সঙ্গে কর্তা প্রভাতবাবুর বিয়ে দিতে চাননি।’
‘হতে পারে। অনাদি হালদার কি তেজারিতির কারবার করত?’
‘না। তাঁকে কখনও টাকা ধার দিতে দেখিনি।’
‘হ্যান্ডনোটে তারিখ দেখছি ১১/৯/১৯৪৬, অর্থাৎ মাসখানেক আগেকার। অনাদি হালদার মেয়ে দেখতে গিয়েছিল কবে?’
‘প্ৰায় ওই সময়। তারিখ মনে নেই।’
‘দয়ালহরি মজুমদার সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?
‘কিছু না। বাইরে শুনেছি মেয়েটি নাকি খুব ভাল গাইতে পারে, এরি মধ্যে খুব নাম করেছে। ওরা পূর্ববঙ্গের লোক, সম্প্রতি কলকাতায় এসেছে।’
‘তাই নাকি! অজিত, দয়ালহরি মজুমদারের ঠিকানাটা মনে করে রাখ তো—’ হাতচিঠি দেখিয়া পড়িল–’১৩/৩, রামতনু লেন, শ্যামবাজার।’
মনে মনে ঠিকানাটা কয়েকবার আবৃত্তি করিয়া লইলাম। ব্যোমকেশ আলমারির নিম্নতম থাকটি তদারক করিতে আরম্ভ করিল।
নীচের থাকে কেবল একটি কাঠের হাত-বাক্স আছে, আর কিছু নাই। হাত-বাক্সের গায় চাবি লাগানো। ব্যোমকেশ চাবি ঘুরাইয়া ডালা তুলিল। ভিতরে একগোছা দশ টাকার নোট, কিছু খুচরা টাকা-পয়সা এবং একটি চেক বহি।
ব্যোমকেশ নোটগুলি গণিয়া দেখিল। দুইশত ষাট টাকা। চেক বহিখানি বেশ পুরু, একশত চেকের বহি; তাহার মধ্যে অর্ধেকের অধিক খরচ হইয়াছে। ব্যোমকেশ ব্যবহৃত চেকের অর্ধাংশগুলি উল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে প্রশ্ন করিল, ‘ভারত ব্যাঙ্ক ছাড়া আর কোনও ব্যাঙ্কে অনাদি হালদার টাকা রাখত?’
নৃপেন বলিল, ‘তিনি কোন ব্যাঙ্কে টাকা রাখতেন তা আমি জানি না।’
‘আশ্চর্য! নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে, কনট্রাকটরকে টাকা দিত কি করে?’
‘ক্যাশ দিতেন। আমি জানি, কারণ আমি রসিদের খসড়া তৈরি করে কনট্রকটরকে দিয়ে সই করিয়ে নিতাম। যেদিন টাকা দেবার কথা, সেদিন বেলা ন’টার সময় কত বেরিয়ে যেতেন, এগারটার সময় ফিরে আসতেন। তারপর কনট্রাকটরকে টাকা দিতেন।’
‘অর্থাৎ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনতে যেতেন?’
‘আমার তাই মনে হয়।’
‘হুঁ। বাড়ির দরুন কনট্রাকটরকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, আপনি জানেন?’
নৃপেন মনে মনে হিসাব করিয়া বলিল, ‘প্রায় ত্ৰিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। রসিদগুলো বোধহয় ফাইলে আছে। যদি জানতে চান–’
ব্যোমকেশ চেক বহি রাখিয়া অর্ধ-স্বাগত বলিল, ‘ভারি আশ্চর্য!-না, চুলচেরা হিসেব দরকার নেই। চল অজিত, এ ঘরে দ্রষ্টব্য যা কিছু দেখা হয়েছে।’ বলিয়া সযত্নে আলমারি বন্ধ করিল।
এই সময় ননীবালা একটি বড় থালার উপর চার পেয়ালা চা লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন, ‘এই নিন। —প্ৰভাত নিজের ঘরে শুয়ে আছে; তার চা দিয়ে এসেছি।’
নৃপেন আলো নিভাইয়া দিল। জানালা দিয়া দেখা গেল বাহিরে বেশ পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে।
আমরা তিনজনে চায়ের পেয়ালা হাতে লইয়া বাহিরের ঘরে আসিলাম, কেষ্টবাবুর চায়ের পেয়ালা থালার উপর লইয়া ননীবালা আমাদের সঙ্গে আসিলেন।
বেঞ্চের উপর লম্বা হইয়া শুইয়া কেষ্টবাবু ঘুমাইতেছেন। ঘর্ঘর শব্দে তাঁহার নাক ডাকিতেছে।
ব্যালকনিতে উঁকি মারিয়া দেখিলাম, অনাদি হালদারের মৃত মুখের উপর সকালের আলো পড়িয়াছে। মাছিরা গন্ধ পাইয়া আসিয়া জুটিয়াছে।
৭
চা শেষ করিয়া পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়াছি, এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের সমবেত শব্দ শোনা গেল। এতক্ষণে বুঝি পুলিস আসিতেছে।
কিন্তু আমার অনুমান ভুল, পুলিসের এখনও ঘুম ভাঙে নাই। যাঁহারা প্রবেশ করিলেন তাঁহারা সংখ্যায় তিনজন; একটি অপরিচিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক, সঙ্গে নিমাই ও নিতাই। ভাগাড়ে মড়া পড়িলে বহু দূরে থাকিয়াও যেমন শকুনির টনক নড়ে, নিমাই ও নিতাই তেমনি খুল্লতাতের মহাপ্ৰস্থানের গন্ধ পাইয়াছে।
পায়ের শব্দে কেষ্টবাবুর ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল, তিনি চোখ রাগড়াইয়া উঠিয়া বসিলেন। ভিতর দিক হইতে প্ৰভােতও প্ৰবেশ করিল।
প্রথমে দুই পক্ষ নিবর্কিভাবে দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। নিমাই ও নিতাই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দুই পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের চক্ষু একে একে আমাদের পর্যবেক্ষণ করিয়া ব্যোমকেশ পর্যন্ত শুক্রমিয়া গেল। দৃষ্টি সন্ধি হইয়া উঠিল। বোধহয় তাহার কোমস্পেকে চিনিতে পারিয়াছে।