আদিম রিপু

প্ৰথমে ব্যোমকেশ কথা বলিল‌, ‘আপনারা কি চান?’

নিমাই ও নিতাই অমনি প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দুই কানে ফুসফুস করিয়া কথা বলিল।

প্রৌঢ় ভদ্রলোকের অক্ষৌরিত মুখে কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ কণ্টকিত হইয়াছিল; অসময়ে ঘুম ভাঙানোর ফলে মেজাজও বোধকরি প্রসন্ন ছিল না। তিনি কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ চক্ষে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া বিকৃতস্বরে বলিলেন‌, ‘আপনি কে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পারিবারিক বন্ধু বলতে পারেন। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী।’

তিনজনের চোখেই চকিত সতর্কতা দেখা দিল। প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটু দাম লইয়া প্রশ্ন করিলেন‌, ‘ডিটেকটিভ?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সত্যান্বেষী।’

প্রৌঢ় ভদ্রলোক গলার মধ্যে অবজ্ঞাসূচক শব্দ করিলেন‌, তারপর প্রভাতের দিকে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘আমরা খবর পেয়েছি অনাদি হালদার মশায়ের মৃত্যু হয়েছে। এরা দুই ভাই নিমাই এবং নিতাই হালদার তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র এবং উত্তরাধিকারী। এঁরা মৃতের সম্পত্তি দখল নিতে এসেছেন। এ বাড়ি আপনাদের ছেড়ে দিতে হবে।’

প্রভাত কিছুক্ষণ অবুঝের মত চাহিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই নাকি? বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! কিন্তু আপনি কে তা তো জানা গেল না।’

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলিলেন‌, ‘আমি এদের উকিল কামিনীকান্ত মুস্তফী।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উকিল। তাহলে আপনার জানা উচিত যে অনাদি হালদারের ভাইপোরা তাঁর উত্তরাধিকারী নয়। তিনি পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন।’

উকিল কামিনীকান্ত নাকের মধ্যে একটি শব্দ করিলেন‌, ব্যোমকেশকে নিরতিশয় অবজ্ঞার সহিত নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনি যখন পারিবারিক বন্ধু আপনার জানা উচিত যে অনাদি হালদার মশায় পোষ্যপুত্র নেননি। মুখের কথায় পোষ্যপুত্র নেওয়া যায় না। দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়‌, যাগযজ্ঞ করতে হয়। অনাদি হালদার মশায় এসব কিছুই করেননি। —আপনাদের এক বস্ত্ৰে এখোন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে‌, একটা কুটা নিয়ে যেতে পাবেন না। এখানে যা-কিছু আছে সমস্ত আমার মক্কেলদের সম্পত্তি।’

ব্যোমকেশ ক্ষণকালের জন্য যেন হতভম্ব হইয়া প্ৰভাতের পানে তাকাইল; তারপর সে সামলাইয়া লইল। মুখে একটা বঙ্কিম হাসি আনিয়া বলিল‌, ‘বটে? ভেবেছেন হুমকি দিয়ে অনাদি হালদারের সম্পত্তিটা দখল করবেন। অত সহজে সম্পত্তি দখল করা যায়‌, না উকিলবাবু। পোষ্যপুত্র নেয়া যে আইনসঙ্গত নয় সেটা আদালতে প্রমাণ করতে হবে‌, সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে‌, তবে দখল পাবেন। বুঝেছেন?’

উকিলবাবু বলিলেন‌, ‘আপনারা যদি এই দণ্ডে বাড়ি ছেড়ে না যান‌, আমি পুলিস ডাকব।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পুলিস ডাকবার দরকার নেই‌, পুলিস নিজেই এল বলে। —ভাল কথা‌, অনাদিবাবু যে মারা গেছেন এটা আপনারা এত শীগগির জানলেন কি করে? এখনও দুঘন্টা হয়নি–’

হঠাৎ নিমাই নিতাইয়ের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল‌, দুঘণ্টা। কাকা মারা গেছেন রাত্তির এগারোটার সময়–’ বলিয়াই অর্ধপথে থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ মধুর স্বরে বলিল‌, ‘এগারোটার সময় মারা গেছেন। আপনি জানলেন কি করে? মৃত্যুকালে আপনি উপস্থিত ছিলেন বুঝি? হাতে বন্দুক ছিল?’

নিমাই নিতাই একেবারে নীল হইয়া গেল। উকিলবাবু নিমাই (কিম্বা নিতাই)-কে ধমক দিয়া বলিলেন‌, ‘তোমরা চুপ করে থাকে‌, বিলাকওয়া আমি করব। আপনারা তাহলে দখল ছাড়বেন। না। আচ্ছা‌, আদালত থেকেই ব্যবস্থা হবে।’ বলিয়া তিনি মক্কেলদের বাহু ধরিয়া সিড়ির দিকে ফিরিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, চললেন? আর একটু সবুর করবেন না? পুলিস এসে ভাইপোদের বয়ান নিশ্চয় শুনতে চাইবে। আপনারা কাল রাত্রি এগারোটার সময় কোথায় ছিলেন–’

ব্যোমকেশের কথা শেষ হইবার পূর্বেই ভ্রাতুষ্পপুত্রযুগল উকিলকে পিছনে ফেলিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া অন্তহিঁত হইল। উকিল কামিনীকান্ত মুস্তকী ব্যোমকেশের প্রতি একটি গরল-ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তাহাদের অনুগমন করিলেন।

তাহাদের পদশব্দ নীচে মিলাইয়া যাইবার পর ব্যোমকেশ প্রভাতের দিকে ফিরিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আপনি যে আইনত অনাদিবাবুর পোষ্যপুত্তুর নন একথা আগে আমাকে বলেননি কেন?’

প্রভাত ক্ষুব্ধ মুখে দাঁড়াইয়া ঘাড় চুলকাইতে লাগিল। এইবার ননীবালা দেবী সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিলেন। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই‌, তাঁহার মুখ শুকাইয়া যেন চুপসিয়া গিয়াছে‌, চোখে ডাবড্যাবে ব্যাকুলত। তিনি বলিয়া উঠিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, ওরা যা বলে গেল তা কি সত্যি? প্রভাত অনাদিবাবুর পুষ্যিপুত্তুর নয়?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সেই কথাই তো জানতে চাইছি?—প্রভাতবাবু–?’

প্ৰভাত ঠোঁট চাটিয়া অস্পষ্টস্বরে বলিল‌, ‘আমি-আইন জানি না। প্ৰথমে কলকাতায় আসবার পর অনাদিবাবু আমাকে নিয়ে সলিসিটারের অফিসে গিয়েছিলেন। সেখানে শুনেছিলাম সুপ্রিশ্ন দিতে হলে দলিল রেজিষ্ট করতে হয়‌, হোম-যজ্ঞ করতে হয়। কিন্তু সে সব কিছু হয়নি।’

‘তাহলে আপনি জানতেন যে আপনি অনাদিবাবুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নন?’

‘হ্যাঁ, জানতাম। কিন্তু ভেবেছিলাম–’

‘ভেবেছিলেন মৃত্যুর আগে অনাদিবাবু দলিল রেজিস্ট্রি করে আপনাকে পুষ্যিপুতুর করে যাবেন?’

‘হ্যাঁ।’

কিছুক্ষণ নীরব। তারপর ননীবালা দীর্ঘকম্পিত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘তাহলে— তাহলে-প্রভাত কিছুই পাবে না। সব ওই নিমাই নিতাই পাবে!’ ননীবালার বিপুল দেহ যেন সহসা শিথিল হইয়া গেল‌, তিনি মেঝোয় বসিয়া পড়িলেন।

প্রভাত তুরিতে গিয়া ননীবালার পাশে বসিল‌, গাঢ় হ্রস্ব স্বরে বলিল‌, ‘তুমি ভাবিছ কেন মা! দোকান তো আছে। তাতেই আমাদের দু’জনের চলে যাবে।’

0 Shares