আদিম রিপু

ননীবালা প্ৰভাতের গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। যাহোক‌, তবু অনাদি হালদারের মৃত্যুর পর একজনকে কাঁদিতে দেখা গেল।

ব্যোমকেশ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া তাহদের নিরীক্ষণ করিল‌, তারপর ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিল‌, ‘নৃপেনবাবু কোথায়?’

এতক্ষণ নৃপেনের দিকে কাহারও নজর ছিল না‌, সে আবার নিঃসাড়ে অদৃশ্য হইয়াছে।

ব্যোমকেশ আমাকে চোখের ইশারা করিল। আমি নৃপেনের ঘরের দিকে পা বাড়াইয়াছি। এমন সময় সে নিজেই ফিরিয়া আসিল। বলিল‌, ‘এই যে আমি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘আমি—একবার ছাদে গিয়েছিলাম।’ নৃপেনের মুখ দেখিয়া মনে হয় সে কোনও কারণে নিশ্চিম্ভ হইয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ছাদে! তেতিলার ছাদে?’

না‌, দোতলাতেই ছাদ আছে।’

‘তাই নাকি? চলুন তো‌, দেখি কেমন ছাদ।’

যে গলি দিয়া নৃপেনের ঘরে যাইবার রাস্তা তাহারই শেষ প্রান্তে একটি দ্বার; দ্বারের ওপারে ছাদ। আলিসা দিয়া ঘেরা দাবার ছকের মত একটু স্থান। পিছন দিকে অন্য একটি বাড়ির দেয়াল‌, পাশে গলির পরপারে অনাদি হালদারের নূতন বাড়ি।

ছাদে দাঁড়াইয়া নুতন বাড়ির কাঠামো স্পষ্ট দেখা যায়‌, এমন কি দীর্ঘলফের অভ্যাস থাকিলে এ-বাড়ি হইতে ও-বাড়িতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। নূতন বাড়ির দেয়াল দোতলার ছাদ পর্যন্ত উঠিয়াছে‌, সবঙ্গে ভারা বাঁধা।

আলিসার ধারে ঘুরিয়া দেখিতে দেখিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ছাদের দরজা রাত্তিরে খোলা থাকে?’

নৃপেন বলিল‌, ‘খোলা থাকবার কথা নয়‌, কত রোজ রাত্রে শুতে যাবার আগে নিজের হাতে দরজা বন্ধ করতেন।’

‘কাল রাত্রে বন্ধ ছিল?’

‘তা জানি না।’

‘আপনি খানিক আগে যখন এসেছিলেন তখন খোলা ছিল‌, না‌, বন্ধ ছিল?’

নৃপেন আকাশের দিকে তাকাইয়া গলা চুলকাইয়, শেষে বলিল, ‘কি জানি, মনে করতে পারছি না। মনটা অন্যদিকে ছিল—’

‘হুঁ।’

আমরা ঘরে ফিরিয়া গেলাম। ননীবালা দেবী তখনও সর্বহারা ভঙ্গীতে মেঝোয় পা ছড়াইয়া বসিয়া আছেন‌, প্রভাত মৃদুকণ্ঠে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতেছে। কেষ্টবাবু বিলম্বিত চায়ের পেয়ালাটি নিঃশেষ করিয়া নামাইয়া রাখিতেছেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পুলিসের এখনও দেখা নেই। আমরা এবার যাই। —এস অজিত‌, যাবার আগে চাবিটা যথাস্থানে রেখে দেওয়া দরকার‌, নইলে পুলিস এসে হাঙ্গামা করতে পারে।’

ব্যালকনিতে গেলাম। মাছিরা দেহটাকে ছকিয়া ধরিয়াছে। ব্যোমকেশ নত হইয়া চাবিটা মৃতের কোমরে ঘুনসিতে পরাইয়া দিতে দিতে বলিল‌, ‘ওহে অজিত‌, দ্যাখো।’

আমি ঝুঁকিয়া দেখিলাম কোমরের সুতার কাছে একটা দাগ‌, আধুলির মত আয়তনের লালচে একটা দাগ‌, জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কিসের দাগ?’

ব্যোমকেশ দাগের উপর আঙুল বুলাইয়া-বলিল‌, রক্তের দাগ মনে হয়। কিন্তু রক্ত নয়। জড়ুল।’

মৃতদেহ ঢাকা দিয়া আমরা ফিরিয়া আসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা চললাম। পুলিস এসে যা-যা প্রশ্ন করবে। তার উত্তর দেবেন‌, বেশি কিছু বলতে যাবেন না। আমি যে আলমারি খুলে দেখেছি তা বলবার দরকার নেই। নিমাই নিতাই যদি আসে তাদের বাড়ি ঢুকতে দেবেন। না।–কেষ্টবাবু্‌, ওবেলা একবার আমাদের বাসায় যাবেন।’

কেষ্টবাবু ঘাড় কত করিয়া সম্মতি জানাইলেন। আমরা নীচে নামিয়া চলিলাম। সূর্য উঠিয়াছে‌, শহরের সোরগোল শুরু হইয়া গিয়াছে।

নীচে নামিয়া আসিয়া দেখিলাম সিঁড়ির ঘরে বৃদ্ধ ষষ্ঠীবাবু থেলো হুঁকা হাতে বিচরণ করিতেছেন‌, আমাদের দেখিয়া বঙ্কিম কটাক্ষপাত করিলেন। প্রথমদিন যে উগ্ৰমূৰ্তি দেখিয়াছিলাম এখন আর তাহা নাই‌, বরং বেশ একটু সাগ্ৰহ কৌতুহলের ব্যঞ্জনা তাঁহার তোবড়ানো মুখখানিকে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছে।

ব্যোমকেশ থমকিয়া দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার নাম ষষ্ঠীবাবু?

তিনি সতর্কভাবে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আপনি-আপনারা-?

ব্যোমকেশ আত্ম-পরিচয় দিল না‌, সংক্ষেপে বলিল‌, ‘আর বলবেন না মশায়। অনাদি হলদারের কাছে টাকা পাওনা ছিল‌, তা দেখছি টাকাটা ডুবল। লোকটা মারা গেছে শুনেছেন বোধহয়।’

ষষ্ঠীবাবুর সন্দিগ্ধ সতর্কতা দূর হইল। তিনি পরম তৃপ্তমুখে বলিলেন‌, ‘শুনেছি। কাল রাত্তির থেকেই শুনছি।–কিসে মারা গেল? শেষোক্ত প্রশ্ন তিনি গলা বাড়াইয়া প্ৰায় ব্যোমকেশের কানে কানে করিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শোনেননি? কেউ তাকে খুন করেছে। —আপনি তো কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত বারান্দায় বসে ছিলেন শুনলাম–’

মুখে বিরক্তিসূচক চুমকুড়ি দিয়ে ষষ্ঠীবাবু বলিলেন, ‘কি করি, পাড়ার ছোঁড়াগুলো ঠিক বাড়ির সামনেই বাজি পোড়াতে শুরু করল। ওই দেখুন না‌, কত তুবড়ির খোল পড়ে রয়েছে। শুধু কি তুবড়ি! চীনে পটকা দোদমার আওয়াজে কান ঝালাপালা। ভাবলাম ঘুম তো আর হবে না‌, বাজি পোড়ানোই দেখি।–তা কি করে খুন হল? ছোরা-ছুরি মেরেছে নকি?’

ব্যোমকেশ প্রশ্নটা এড়াইয়া গিয়া বলিল‌, তাহলে আপনি সন্ধের পর থেকে দুপুর রাত্রি পর্যন্ত বারান্দায় বসে ছিলেন। সে সময়ে কেউ অনাদি হালদারের কাছে এসেছিল?’

‘কেউ না। একেবারে রাত বারোটার পর ওই ছেলেটা আর তার মা এল‌, এসেই দ্বোর ঠ্যাঙাতে শুরু করল। তারপর এল ন্যাপা। তারপর কেষ্ট দাস।’

‘ইতিমধ্যে আর কেউ আসেনি?’

‘বাড়িতে কেউ ঢোকেনি। তবে-অনাদি হালদারের একটা ভাইপোকে একবার ওদিকে ফুটপাথের হোটেলের সামনে ঘুর-ঘুর করতে দেখেছি।’

‘তাই নাকি? তারপর?’

‘তারপর আর দেখিনি। অন্তত এ বাড়িতে ঢোকেনি।’

‘কাঁটার সময় তাকে দেখেছিলেন?’

‘তা কি খেয়াল করেছি। তবে গোড়ার দিকে তখনও হোটেলের দোতলায় বাবুরা জানলার ধারে বসে পাশা খেলছিল। দশটা কি সাড়ে দশটা হবে।–আচ্ছা‌, কে মেরেছে কিছু জানা গেছে নাকি?’

0 Shares