ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ হেঁট মুখে চিন্তা করিল, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করিল, ‘অনাদি হালদারের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?’
ষষ্ঠীবাবু চমকিয়া উঠিলেন, ‘অ্যাঁ! সদ্ভাব, মানে, অসদ্ভাবও ছিল না।’
‘আপনি কাল রাত্রে ওপরে যাননি?’
‘আমি! আমি ওপরে যাব! বেশ লোক তো আপনি? মতলব কি আপনার? ষষ্ঠীবাবু ক্রমশ তেরিয়া হইয়া উঠিবার উদ্যোগ করিলেন।
‘অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে আপনি জানেন না?’
‘আমি কি জানি! যে খুন করেছে। সে জানে, আমি কি জানি। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! আমি বুড়ো মানুষ, কারুর সাতেও নেই পাঁচেও নেই, আমাকে ফাঁসাতে চান?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া ফেলিল, ‘আমি আপনাকে ফাঁসাতে চাই না, আপনি নিজেই নিজেকে ফাঁসাচ্ছেন। অনাদি হালদারের মৃত্যুতে এত খুশি হয়েছেন যে চেপে রাখতে পারছেন না। —চল অজিত, ওই হোটেলটাতে গিয়ে আর এক পেয়ালা চা খাওয়া যাক।’
ষষ্ঠীবাবু্, থ হইয়া রহিলেন, আমরা ফুটপাথে নামিয়া আসিলাম। রাস্তার ওপারে হোটেলের মাথার উপর মস্ত পরিচয়-ফলক শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাস। শ্ৰীকান্ত বোধহয় হোটেলের মালিকের নাম। নীচের তলায় রেস্তোরাঁয় চা-পিয়াসীর দল বসিয়া গিয়াছে, দ্বিতলে জানালার সারি, কয়েকটা খোলা। ব্যোমকেশ পথ পার হইবার জন্য পা বাড়াইয়া হঠাৎ থামিয়া গেল, বলিল, ‘দাঁড়াও, গলির মধ্যেটা একবার দেখে যাই।’
‘গলির মধ্যে কী দেখবো?’
‘এসই না।’
অনাদি হালদারের বাসা ও নুতন বাড়ির মাঝখান দিয়া গলিতে প্রবেশ করিলাম। একেই গলিটি অত্যন্ত অপ্রশস্ত, তার উপর নূতন বাড়ির স্বলিত বিক্ষিপ্ত ইটসুরকি এবং ভারা বাঁধার খুঁটি মিলিয়া তাহাকে আরও দুৰ্গম করিয়া তুলিয়াছে। ব্যোমকেশ মাটির দিকে নজর রাখিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল।
গলিটি কানা গলি, বেশি দূর যায় নাই। তাহার শেষ পর্যন্ত গিয়া ব্যোমকেশ ফিরিল, আবার মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া চলিতে লাগিল। তারপর অনাদি হালদারের বাসার পাশে পৌঁছিয়া হঠাৎ অবনত হইয়া একটা কিছু তুলিয়া লইল।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি পেলে?’
সে মুঠি খুলিয়া দেখাইল, একটি চকচকে নূতন চাবি। বলিলাম, চাবি! কোথাকার চাবি?’
ব্যোমকেশ একবার উর্ধে জানালার দিকে চাহিল, চাবিটি পকেটে রাখিয়া বলিল, ‘হলফ নিয়ে বলতে পারি না, তবে সন্দেহ হয় অনাদি হালদারের আলমারির চাবি।’
‘কিন্তু–’
‘আন্দাজ করেছিলাম গলির মধ্যে কিছু পাওয়া যাবে। এখন চল, চা খাওয়া যাক।’
‘কিন্তু, আলমারির চাবি তো—’
‘অনাদি হালদারের কোমরে আছে। তা আছে। কিন্তু আর একটা চাবি থাকতে বাধা কি?’
‘কিন্তু, গলিতে চাবি এল কি করে?’
‘জানিলা দিয়ে।–এস।’ ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল।
শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাসে প্রবেশ করিয়া একটি টেবিলে বসিলাম। ভৃত্য চা ও বিস্কুট দিয়া গেল। ভৃত্যকে প্রশ্ন করিয়া জানা গেল হোটেলের মালিক শ্ৰীকান্ত গোস্বামী পাশেই একটি ঘরে আছেন। চা বিস্কুট সমাপ্ত করিয়া আমরা নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকিলাম।
ঘরটি শ্ৰীকান্তবাবুর অফিস; মাঝখানে টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার। শ্ৰীকান্তবাবু মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, চেহারা গোলগাল, মুণ্ডিত মুখ; বৈষ্ণবোচিত প্রশান্ত ভাব। তিনি গত রাত্রির বাসি ফাউল কাটলেট সহযোগে চা খাইতেছিলেন, আমাদের আকস্মিক আবিভাবে একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন।
ব্যোমকেশ সবিনয়ে বলিল, ‘মাফ করবেন, আপনিই কি হোটেলের মালিক শ্ৰীকান্ত গোস্বামী মশায়?’
গোস্বামী মহাশয়ের মুখ ফাউল কাটলেটে ভরা ছিল, তিনি এক চুমুক চা খাইয়া কোনও মতে তাহা গলাধঃকরণ করিলেন, বলিলেন, ‘আসুন। আপনারা-?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটু দরকারে এসেছি। সামনের বাড়িতে কাল রাত্রে খুন হয়ে গেছে শুনেছেন বোধহয়?’
‘খুন!’ শ্ৰীকান্তবাবু ফাউল কাটলেটের প্লেট পাশে সরাইয়া দিলেন, ‘কে খুন হয়েছে?’
‘১৭২/২ নম্বর বাড়িতে থাকত-অনাদি হালদার।’
শ্ৰীকান্তবাবু চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন, ‘অনাদি হালদার খুন হয়েছে! বলেন কি?’
‘তাকে আপনি চিনতেন?’
‘চিনতাম বৈকি। সামনের বাড়ির দোতলায় থাকত, নতুন বাড়ি তুলছিল। প্রায় আমার হোটেলে এসে চিপ কাটলেট খেত।–কাল রাত্তিরেও যে তাকে দেখেছি।’
‘তাই নাকি! কোথায় দেখলেন?’
‘ওর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় বাজি পোড়ানো দেখছিল। যখনই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছি তখনই দেখেছি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কখন কোথা থেকে কি দেখলেন সব কথা। দয়া করে বলুন। আমি অনাদি হালদারের খুনের তদন্ত করছি। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী।’
শ্ৰীকান্তবাবু বিস্ময়াপ্লুত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘আপনি ব্যোমকেশবাবু! কি সৌভাগ্য।’ তিনি ভূত্য ডাকিয়া আমাদের জন্য চা ও ফাউল কাটলেট হুকুম দিলেন। আমর এইমাত্র চা বিস্কুট খাইয়াছি বলিয়াও পরিত্রাণ পাওয়া গেল না।
তারপর শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন, ‘আমার হোটেলের দোতলায় দুটো ঘর নিয়ে আমি থাকি, বাকি তিনটে ঘরে কয়েকজন ভদ্রলোক মেস করে আছেন। সবসুদ্ধ এগারজন। তার মধ্যে তিনজন কালীপুজোর ছুটিতে দেশে গেছেন, বাকি আটজন বাসাতেই আছেন। কাল সন্ধ্যের পর ১ নম্বর আর ৩ নম্বর ঘরের বাবুরা ঘরে তালা দিয়ে শহরে আলো দেখতে বেরুলেন। ২ নম্বর ঘরের যামিনীবাবুরা তিনজন বাসাতেই রইলেন। ওঁদের খুব পাশা খেলার শখ। আমিও খেলি। কাল সন্ধ্যে সাতটার পর ওঁরা আমাকে ডাকলেন, আমরা চারজন যামিনীবাবুর তক্তপোশে পাশা খেলতে বসলাম। যামিনীবাবুর তক্তপোশ ঠিক রাস্তার ধারে জানলার সামনে। সেখানে বসে খেলতে খেলতে যখনই বাইরের দিকে চোখ গেছে তখনই দেখেছি। অনাদি হালদার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাজি পোড়ানো দেখছে। আমরা তিন দান খেলেছিলাম, প্ৰায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত খেলা চলেছিল।’