‘তারপর আর অনাদি হালদারকে দেখেননি?’
‘না, তারপর আমরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম, অনাদি হালদারকে আর দেখিনি।’
‘যে বাবুরা আলো দেখতে বেরিয়েছিলেন তাঁরা কখন ফিরলেন?’
‘তাঁদের মধ্যে দু’জন ফিরেছিলেন রাত বারোটার সময়, বাকি বাবুরা এখনও ফেরেননি।’
‘এখনও আলো দেখছেন।’
শ্ৰীকান্তবাবু অধরোষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন; মনুষ্য জাতির ধাতুগত দুর্বলতা সম্বন্ধে বোধকরি নীরবে খেদ প্রকাশ করিলেন।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে কাটলেট চিবাইল, তারপর বলিল, ‘দেখুন, অনাদি হালদারের লাশ পাওয়া গেছে। ওই ব্যালকনিতেই, বুকে বন্দুকের গুলি লেগে পিঠ ফুড়ে বেরিয়ে গেছে। তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে আপনার হোটেল থেকে কেউ বন্দুক ছুঁড়ে অনাদি হালদারকে মেরেছে—’
শ্ৰীকান্তবাবু আবার চক্ষু কপালে তুলিলেন–’আমার হোটেল থেকে! সে কি কথা! কে মারবে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এটা আন্দাজ মাত্র। আপনি বলছেন সন্ধ্যে সাতটা থেকে আপনারা চারজন ছাড়া দোতলায় আর কেউ ছিল না। এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ?’
শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন, ‘মেসের বাসিন্দা আর কেউ ছিল না। এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। তবে–দাঁড়ান। একটা চাকর দোতলার কাজকর্ম করে, সে বলতে পারবে। হরিশ! ওরে কে আছিস হরিশকে ডেকে দে।’
কিছুক্ষণ পরে হরিশ আসিল, ছিটের ফতুয়া পরা আধ-বয়সী লোক। শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন, ‘কাল সন্ধ্যে থেকে তুই কোথায় ছিলি?’
হরিশ বলিল, ‘আজ্ঞে, ওপরেই তো ছিলুম। বাবু্, সারাক্ষণ সিঁড়ির গোড়ায় বসেছিলুম। আপনারা শতরঞ্চি খেলতে বসলেন–’
‘কতক্ষণ পর্যন্ত ছিলি?’
‘আজ্ঞে, রাত দুপুরে ধীরুবাবু আর মানিকবাবু ফিরলেন, তখন আমি সিঁড়ির পাশের কম্বল পেতে শুয়ে পড়লুম। কোথাও তো যাইনি বাবু।’
শ্রীকান্তবাবু ব্যোমকেশের দিকে তাকাইলেন, ব্যোমকেশ হরিশকে প্রশ্ন করিল, ‘বাবুরা পাশা খেলতে আরম্ভ করবার পর থেকে রাত্ৰি বারোটা পর্যন্ত তুমি সারাক্ষণ সিঁড়ির কাছে বসেছিলে, একবারও কোথাও যাওনি?’
হরিশ বলিল, ‘একবারটি পাঁচ মিনিটের জন্যে নীচে গেছলুম যামিনীরাবুর জন্যে দোক্তা আনতে।’
শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, যামিনীবাবু ওকে একবার দোক্তা আনতে পাঠিয়েছিলেন বটে।’
‘সে কখন? ক’টার সময়?’
‘আজ্ঞে, রাত্তির তখন নটা হবে।’
‘ছ। রাত্ৰি নটা থেকে দুপুর রাত্রি পর্যন্ত দোতলায় কেউ আসেনি?
‘দোতলায় কেউ আসেনি বাবু। দশটা নাগাদ তেতলার ভাড়াটে বাবু এসেছিলেন, কিন্তু তিনি দোতলায় দাঁড়াননি, সটান তেতলায় উঠে গেছলেন।’
ব্যোমকেশ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া শ্ৰীকান্তবাবুর পানে চাহিল। তিনি বলিলেন, ‘ওহো, তেতলার ভাড়াটের কথা বলা হয়নি। তেতিলায় একটা ছোট ঘর আছে, চিলেকোঠা বলতে পারেন। এক ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন। ঘরে পাকাপাকি থাকেন না, খাওয়া-দাওয়া করেন। না। তবে রোজ সকাল-বিকেল আসেন, ঘরের মধ্যে দোর বন্ধ করে কি করেন জানি না, তারপর আবার তালা লাগিয়ে চলে যান। একটু অদ্ভুত ধরনের লোক।’
‘নাম কি ভদ্রলোকের?’
‘নাম? দাঁড়ান বলছি–শ্ৰীকান্তবাবু একখানা বাঁধানো খাতা খুলিয়া দেখিলেন— নিত্যানন্দ ঘোষাল।’
‘নিত্যানন্দ ঘোষাল।’ ব্যোমকেশ একবার আড়চোখে আমার পানে চাহিল-‘রোজ দু’বেলা যখন আসেন তখন কলকাতার লোক বলেই মনে হচ্ছে। কতদিন আছেন। এখানে?’
‘প্রায় ছ’ মাস। নিয়মিত ভাড়া দেন, কোনও হাঙ্গামা নেই।’
‘কি রকম চেহারা বলুন তো?’
‘মোটাসোটা গোলগাল।’
ব্যোমকেশ আবার আমার পানে কটাক্ষপাত কুরিয়া মুচকি হাসিল—’চেনা-চেনা ঠেকছে—‘ ‘হরিশকে বলিল, ‘নিত্যানন্দবাবু দশটা নাগাদ এসেছিলেন? তোমার সঙ্গে কোনও কথা হয়েছিল?’
হরিশ বলিল, ‘আৰ্জেজ্ঞ না, উনি কথাবার্তা বলেন না। ব্যাগ হাতে সটান তেতলায় উঠে গেলেন।’
‘ব্যাগ!’
‘আজেজ্ঞ। উনি যখনই আসেন সঙ্গে চামড়ার ব্যাগ থাকে।’
‘তাই নাকি! কত বড় ব্যাগ?’
‘আজ্ঞে, লম্বা গোছের ব্যাগ; সানাই বাঁশী রাখার ব্যাগের মত।’
‘ক্ল্যারিওনেট রাখার ব্যাগের মত? ভদ্রলোক তেতলার ঘরে নিরিবিলি বাঁশী বাজানো অভ্যোস করতে আসেন নাকি?’
‘আজ্ঞে, কোনও দিন বাজাতে শুনিনি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গভীর চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল। তারপর মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, ‘কাল রাত্রে উনি কখন ফিরে গেলেন?’
‘ঘণ্টাখানেক পরেই। খুব ব্যস্তসমস্তভাবে তরুতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।’
‘ও!— আচ্ছা, তুমি এবার যেতে পারো।’। হরিশ শূন্য পেয়ালা প্লেট প্রভৃতি লইয়া প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ শ্ৰীকান্তবাবুকে বলিল, ‘ওপরতলাগুলো একবার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। আপত্তি আছে কি?’
‘বিলক্ষণ, আপত্তি কিসের? আসুন।’ শ্ৰীকস্তবাবু আমাদের উপরতলায় লইয়া চলিলেন।
দ্বিতলে পাশাপাশি পাঁচটি বড় বড় ঘর, সামনে টানা বারান্দা। সিঁড়ি দিয়া উঠিয়াই প্রথম দু’টি ঘর শ্ৰীকান্তবাবুর। দ্বারে তালা লাগানো ছিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি একলা থাকেন?’
শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন, ‘আপাতত একলা। স্ত্রীকে ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। যা দিনকাল।’
‘বেশ করেছেন।’
এক নম্বর ঘরে তালা লাগানো, বাবুরা এখনও ফেরেন নাই। দু’ নম্বর ঘরে তিনটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক রহিয়াছেন। একজন মেঝোয় বসিয়া জুতা পালিশ করিতেছেন, দ্বিতীয় ব্যক্তি দাড়ি কামাইতেছেন, তৃতীয় ব্যক্তি খোলা জানালার ধারে বিছানায় কান্ত হইয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন। জানোলা দিয়া রাস্তার ওপারে অনাদি হালদারের বাসা সোজাসুজি দেখা যাইতেছে। ব্যালকনির ভিতর দৃষ্টি প্রেরণ করিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু ঢালাই লোহার ঘন রেলিং-এর ভিতর দিয়া কিছু দেখা গেল না।