আদিম রিপু

ব্যোমকেশের বাল্য ইতিহাস আমার জানা ছিল। তাহার যখন সতেরো বছর বয়স। তখন তাহার পিতার যক্ষ্মা হয়‌, মাতাও সেই রোগে মারা যান। আত্মীয়স্বজন কেহ উঁকি মারেন নাই। তারপর ব্যোমকেশ জলপানির জোরে বিশ্ববিদ্যা সমুদ্র পার হইয়াছে, নিজের চেষ্টায় নূতন জীবন-পথ গড়িয়া তুলিয়াছে। আত্মীয়স্বজন এখনও হয়তো আছেন‌, কিন্তু ব্যোমকেশ তাঁহাদের খোঁজ রাখে না।

কিছুক্ষণ বিমনাভাবে কাটিয়া গেল। আজ সত্যবতীর একখানা চিঠি আসিতে পারে‌, মনে মনে তাহারই প্ৰতীক্ষা করিতেছি।

খট্‌ খট্‌ খট্‌ খট্‌ কড়া নড়িয়া উঠিল। আমি উঠিয়া গিয়া দ্বার খুলিলাম।

ডাকপিওন নয়। তৎপরিবর্তে যিনি দ্বারের বাইরে দাঁড়াইয়া আছেন‌, বেশবাস দেখিয়া তাঁহাকে স্ত্রীলোকই বলিতে হয়। কিন্তু সে কী স্ত্রীলোক! পাঁচ হাত লম্বা‌, তদনুপাতে চওড়া‌, শালপ্ৰাংশু আকৃতি; পালিশ করা আবলুশ কাঠের মত গায়ের রঙ; ঘটোধ্নী‌, নিবিড়নিতম্বিনী‌, স্পষ্ট একজোড়া গোঁফ আছে; বয়স পঞ্চাশের ওপারে। তিনি আমার দিকে চাহিয়া হাস্য করিলেন; মনে হইল। হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলিয়া গেল।

তিনি রামায়ণ মহাভারত হইতে বিনিৰ্গতা কোনও অতি-মানবী। কিনা ভাবিতেছি। হারমোনিয়াম হইতে খাদের গভীর আওয়াজ বাহির হইল‌, ‘আপনি কি ব্যোমকেশবাবু?’

আমি অতি দ্রুত মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিলাম। ব্যোমকেশের সহিত মহিলাটির কি প্রয়োজন জানি না‌, কিন্তু আমি যে ব্যোমকেশ নই তাহা অকপটে ব্যক্ত করাই সমীচীন। ব্যোমকেশ ঘরের ভিতর হইতে মহিলাটিকে দেখিতে পায় নাই, আমার অবস্থা দেখিয়া উঠিয়া আসিল। সেও অভ্যাগতকে দেখিয়া ক্ষণেকের জন্য থতমত খাইয়া গেল‌, তারপর সৎসাহস দেখাইয়া বলিল‌, ‘আমি ব্যোমকেশ।’

মহিলাটি আবার হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলিলেন‌, বলিলেন‌, নমস্কার। আমার নাম মিস। ননীবালা রায়। আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।’

‘আসুন।’

খট্‌ খট্‌ জুতার শব্দ করিয়া মিসা ননীবালা রায় ঘরে প্রবেশ করিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে চেয়ারে বসাইল। আমি ভাবিতে লাগিলাম‌, এরূপ আকৃতি লইয়া ইনি কখনই ঘরের ঘরণী হইতে পারেন না‌, স্বামীপুত্র ঘরকন্না গৃহস্থলী ইহার জন্য নয়। বিশেষ নামের অগ্ৰে ‘মিস’ খেতাবটি দাম্পত্য সৌভাগ্যের বিপরীত সাক্ষ্য দিতেছে। তবে ইনি কি? জেনানা ফাটকের জমাদারণী? উৰ্হ্‌্‌, অতটা নয়। শিক্ষয়িত্রী? বোধ হয় না। লেডি ডাক্তার? হইতেও পারে—

পরক্ষণেই ননীবালা নিজের পরিচয় দিলেন। দেখিলাম বেশি ভুল করি নাই। তিনি বলিলেন‌, ‘আমি পাটনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধাত্রী ছিলাম‌, এখন রিটায়ার করে কলকাতায় আছি। একজনের কাছে আপনার নাম শুনলাম‌, ঠিকানাও পেলাম। তাই এসেছি।’

ব্যোমকেশ গম্ভীরমুখে বলিল‌, ‘কি দরকার বলুন।’

মিস ননীবালার চেহারা যেরূপ জবরদস্ত, আচার আচরণ কিন্তু সেরূপ নয়। তাঁহার হাতে একটা কালো রঙের হ্যান্ডব্যাগ ছিল‌, তিনি সেটা খুলিবার উপক্ৰম করিয়া বলিলেন‌, ‘আমি গরীব মানুষ‌, ব্যোমকেশবাবু। টাকাকড়ি বেশি আপনাকে দিতে পারব না—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘টাকাকড়ির কথা পরে হবে। কি দরকার আগে বলুন।’

ননীবালা ব্যাগ বন্ধ করিলেন‌, তারপর সহসা কম্পিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আমার ছেলের বড় বিপদ‌, তাকে আপনি রক্ষে করুন‌, ব্যোমকেশবাবু–।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাঁহার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আপনার—ছেলে!’

ননীবালা একটু অপ্ৰস্তুত হইলেন‌, বলিলেন‌, ‘আমার ছেলে-মানে-আমি মানুষ করেছি। অনাদিবাবু তাকে পুষ্যিপুকুর নিয়েছেন—‘

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বড় পাঁচালো ব্যাপার দেখছি। আপনি গোড়া থেকে সব কথা বলুন।’ ননীবালা তখন নিজের কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার গল্প বলার শৈলী ভাল নয়‌, কখনও দশ বছর পিছইয়া কখনও বিশ বছর আগাইয়া বহু অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়া যাহা বলিলেন‌, তাহার জট ছাড়াইলে এইরূপ দাঁড়ায়–

বাইশ তেইশ বছর আগে মিসা ননীবালা রায় পাটনা হাসপাতালের ধাত্রী ছিলেন। একদিন একটি যুবতী হাসপাতালে ভর্তি হইল; অবস্থা খুবই খারাপ‌, ধুরিসির সহিত নানা উপর্সা‌, তার উপর পূর্ণগভর্ণ। যে পুরুষটি তাহাকে আনিয়াছিল‌, সে ভর্তি করিয়া দিয়াই অদৃশ্য হইল।

যুবতী হিন্দু নয়‌, বোধ হয় আদিম জাতীয় দেশী খ্ৰীষ্টান। দুই দিন পরে সে একটি পুত্র প্রসব করিয়া মারা গেল। পুরুষটা সেই যে উধাও হইয়াছিল‌, আর ফিরিয়া আসিল না।

এইরূপ অবস্থায় শিশুর লালন-পালনের ব্যবস্থা রাজ সরকার করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ননীবালা শিশুটির ভার লাইলেন। ননীবালা অবিবাহিতা‌, সন্তানাদি নাই‌, শিশুটি বড় হইয়া তাঁহার পুত্রের স্থান অধিকার করিবে এই আশায় তিনি শিশুকে পুত্ৰবৎ পালন করিতে লাগিলেন। শিশুর নাম হইল প্ৰভাত রায়।

প্রভাতের বয়স তখন তিন-চার, তখন ননীবালা হঠাৎ একটি ইন্সিওর চিঠি পাইলেন। চিঠির সঙ্গে দুই শত টাকার নোট। চিঠিতে লেখা আছে, আমি জানিতে পারিয়াছি আমার ছেলে তোমার কাছে আছে। তাহাকে পালন করিও। উপস্থিত কিছু টাকা পাঠাইলাম, সুবিধা হইলে আরও পাঠাইব।–চিঠিতে নাম দস্তখত নাই।

তারপর প্রভাতের বাপের আর কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নাই। লোকটা সম্ভবত মরিয়া গিয়াছিল। ননীবালা বিশেষ দুঃখিত হইলেন না। বাপ কোনও দিন আসিয়া ছেলেকে লইয়া যাইবে এ আশঙ্কা তাঁহার ছিল। তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন।

প্রভাত বড় হইয়া উঠিতে লাগিল। ননীবালা নিজের ডিউটি লইয়া থাকেন, ছেলের দেখাশুনা ভাল করিতে পারেন না ; প্রভাত পাড়ার হিন্দুস্থানী ছেলেদের সঙ্গে রাস্তায় খেলা করিয়া বেড়ায়। তাহার লেখাপড়া হইল না।

0 Shares