তিন নম্বর ঘরে ধীরুবাবু ও মানিকবাবু সবেমাত্র বিছানায় উঠিয়া বসিয়াছেন এবং তুড়ি দিয়া হাই তুলিতেছেন। শ্ৰীকান্তবাবু সহাস্যে বলিলেন, ‘কী, ঘুম ভাঙল?’
দু’জনে বাহু উর্ধে তুলিয়া আড়মোড়া ভাঙিলেন।
চলিল। একই সিঁড়ি ত্রিতলে গিয়াছে, তাহা দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল। শ্ৰীকান্তবাবু ও আমি পিছনে রহিলাম।
ত্রিতলে একটি ঘর, বাকি ছাদ খোলা! ঘরের দরজায় তালা লাগানো।
ব্যোমকেশ শ্ৰীকান্তবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার কাছে চাবি আছে নাকি?’
‘না। তবে—’ তিনি পকেট হইতে চাবির একটা গোছা বাহির করিয়া বলিলেন, ‘দেখুন। যদি কোন চাবি লাগে। ভাড়াটের অবর্তমানে তার ঘর খোলা বোধহয় উচিত নয়, কিন্তু বর্তমান অবস্থায়–’
চাবির গোছা লইয়া ব্যোমকেশ কয়েকটা চাবি লোগাইয়া দেখিল। সস্তা তালা, বেশি চেষ্টা করিতে হইল না, খুট করিয়া খুলিয়া গেল।
আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম।। ঘরের একটিমাত্র জানালা রাস্তার দিকে খোলা রহিয়াছে। আসবাবের মধ্যে একটি উলঙ্গ তক্তপোশ ও একটি লোহার চেয়ার। আর কিছু নাই।
ব্যোমকেশ কোনও দিকে দৃকপাত না করিয়া প্রথমেই জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। নীচে প্রশস্ত রাস্তার উপর মানুষ ও যানবাহনের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে। ওপারে অন্যান্য বাড়ির সারির মধ্যে অনাদি হালদারের ব্যালকনি।
ব্যোমকেশ সেই দিকে চাহিয়া কতকটা আপন মনেই বলিল, ‘কাল রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময়…রাস্তায় ছেলেরা বাজি পোড়াচ্ছে…চারিদিকে দুমদাম শব্দ-অনাদি হালদার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাজি পোড়ানো দেখছে..সেই সময় জানলা থেকে তাকে গুলি করা কি খুব শক্ত? গুলির আওয়াজ শোনা গেলেও বোমা ফাটার আওয়াজ বলেই মনে হবে।’
শ্ৰীকান্তবাবু বললেন, তা বটে। কিন্তু হোটেলে এত লোকের চোখে ধুলো দিয়ে বলুক আনা কি সহজ?
‘আপনার ভাড়াটে হাতে ব্যাগ নিয়ে হোটেলে আসে। ব্যাগের মধ্যে একটা পিস্তল কিম্বা রিভলবার সহজেই আনা যায়।’
‘কিন্তু রাইফেল কিম্বা বন্দুক আনা যায় কি? আমাকে মাফ করবেন, আমি অদ্বৈত বংশের সন্তান, গোলাগুলি বন্দুক পিস্তলের ব্যাপার কিছুই বুঝি না। তবু মনে হয়, পিস্তল কিংবা রিভলবার দিয়ে এতদূর থেকে মানুষ মারা সহজ কাজ নয়।’
উত্তরে ব্যোমকেশ কেবল গলার মধ্যে একটা শব্দ করিল। তারপর নিরাভরণ ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল, চলুন, যাওয়া যাক, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম— বলিতে বলিতে থামিয়া গেল। দেখিলাম তাহার দৃষ্টি দেয়ালের একটা স্থানে আটকাইয়া গিয়াছে।
জানালার ঠিক উল্টা পিঠে দেয়ালের ছাদের কাছে খানিকটা চুন বালি খসিয়া গিয়াছে। তাহার নীচে মেঝের উপর খসিয়া-পড়া চুন বালি পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ ত্বরিতে গিয়া চুন বালি পরীক্ষা করিল, বলিল, ‘নতুন খসেছে মনে হচ্ছে। শ্ৰীকান্তবাবু্, এ ঘর রোজ ঝটপট দেওয়া হয়?’
শ্ৰীকান্তবাবু বলিলেন, ‘না। ঘর খোলা থাকে না—’
ব্যোমকেশ দু’ পা সরিয়া আসিয়া উর্ধমুখে চাহিয়া রহিল।
‘দেয়ালের এই চুন-বালি কবে খসেছে আপনি বলতে পারেন না?’
‘না। এইটুকু বলতে পারি ছ। মাস আগে যখন ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম তখন প্ল্যাস্টার ঠিক ছিল। ‘
‘হুঁ। অজিত, চৌকিটা ধরতো, একবার দেখি–’
দু’জনে চৌকি ধরিয়া দেয়ালে ঘেষিয়া রাখিলাম; তাহার উপর লোহার চেয়ার রাখিয়া ব্যোমকেশ তদুপরি আরোহণ করিল। সেখান হইতে হাত বাড়াইয়া দেয়ালের ক্ষতস্থানটার নাগাল পাওয়া যায়। ব্যোমকেশ আঙুল দিয়া স্থানটা হাতড়াইল, তারপর একটি ক্ষুদ্র বস্তু হাতে লইয়া নামিয়া আসিল। পেন্সিলের ক্যাপের মত লম্বাটে আকৃতির একটি ধাতব পদার্থ্্, তাহার গায়ে রাইফেলের পেচানো রেখাচিহ্ন।
রাইফেলের টোটা। ব্যোমকেশ সেটি ঘুরাইয়া দেখিতে দেখিতে বলিল, ‘এ বস্তু এখানে এল কি করে? কবে এল?—ঘরের মধ্যে কেউ রাইফেল ছুড়েছিল? কিম্বা–’ ব্যোমকেশ জানালার দিকে চাহিল, ‘অনাদি হালদার যদি ব্যালকনি থেকে জানালা লক্ষ্য করে রাইফেল ছুঁড়ে থাকে তাহলে গুলিটা দেয়ালের ওই জায়গায় লাগা সম্ভব। অথবা–’
৯
বাসায় ফিরিতে দেরি হইল। রাত্রি সাড়ে তিনটা হইতে বেলা সাড়ে আটটা পর্যন্ত কোন দিক দিয়া কাটিয়া গিয়াছে জানিতে পারি নাই।
ফিরিয়া আসিয়াই ব্যোমকেশ খবরের কাগজ লইয়া বসিয়া গেল। আমি কয়েকবার অনাদি-প্ৰসঙ্গ আলোচনার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু সে গায়ে মাখিল না। একবার অন্যমনস্কভাবে চোখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ?
আমি রাগ করিয়া নিরুত্তর হইলাম। কুক্ষণে খোকাকে একখানি আবোল-তাবোল কিনিয়া দিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ বইখানি মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে এবং সময়ে অসময়ে আবৃত্তি করিয়া শুনাইতেছে।
গত রাত্রে নিদ্রায় ঘাটতি পড়িয়াছিল, দুপুরবেলা তাহা পূরণ করিয়া লইলাম। বৈকালের চা পান করিতে বসিয়া ব্যোমকেশ নিজেই কথা পাড়িল, ‘কেষ্টবাবুর এখনও দেখা নেই। মনে হচ্ছে সবাই গা এলিয়ে দিয়েছে।’
বলিলাম, ‘কেষ্টবাবুর যখন গলায় কাঁটা বিঁধেছিল, তখন ছুটে এসেছিল। এখন বোধহয় কাঁটা বেরিয়ে গেছে তাই গা-ঢাকা দিয়েছে।’
‘তাই হবে। কিন্তু ওরা যদি না আসে, আমিই বা কি করতে পারি। কেসটা বেশ রহস্যময়–’
‘কে খুন করেছে এখনও বুঝতে পারনি?’
‘উহু। কিন্তু যেই করুক, খুব ভেবেচিন্তে আটঘটি বেঁধে করেছে। কালীপুজোর রাত্তির, চতুর্দিকে বোমা ফাটার শব্দ, তার মধ্যে একটি বন্দুকের আওয়াজ। প্ল্যান করে খুন না করলে এমন যোগাযোগ হয় না।’