‘কে এমন গ্ল্যান করতে পারে?’
‘কে না করতে পারে। সকলেরই স্বার্থ রয়েছে, সকলেরই সুযোগ রয়েছে।’
‘সকলে কারা?’
‘একে একে ধর। প্রথমে ধর নিমাই নিতাই। খুড়ো পুষ্যিপুত্তুর নিলেই খুড়োর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যায়, অতএব খুড়োকে পুষ্যিপুতুর নেবার আগেই সরানো দরকার। নিমাই নিতাইয়ের মধ্যে একজন শ্ৰীকান্ত হোটেলের চুড়োয় আড্ডা গাড়ল, বন্দুক নিয়ে ওৎ পেতে রইল। কালীপুজের রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে বন্দুকের গুলি ছুটিল। খুড়ো কুপোকাৎ। কাম ফতে।’
‘তাহলে ভাইপোরাই খুন করেছে, অন্য কারুর ওপর সন্দেহের কারণ নেই।’
‘কারণ যথেষ্ট আছে। শ্ৰীকান্ত হোটেলের তেতলার ঘরে রাইফেলের গুলি এল কোথ’। থেকে? ওই ঘর থেকে বন্দুক ছোঁড়া হয়েছিল এটা একটা অনুমান বটে, কিন্তু অনিবার্য অনুমান নয়। ভেবে দেখ, অনাদি হালদার ব্যালকনিতে যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তার পেছনেই দরজা। পিছন থেকে গুড়ি মেরে এসে কেউ যদি তাকে গুলি করে, তাহলে গুলিটা তার শরীর কুঁড়ে শ্ৰীকান্ত হোটেলের তেতলার ঘরের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকবে এবং দেয়ালে আটকে যাবে।’
‘সম্ভব বটে। কিন্তু গোড়াতেই তো গলদ। অনাদি হালদারের বাসায় সে ছাড়া আর কেউ ছিল না, দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ ছিল। তাছাড়া আর একটা কথা, গুলিটা অনাদি হালদারের বুকের দিক দিয়ে ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বেরিয়েছিল, না পিঠের দিক দিয়ে ঢুকে বুকের দিক দিয়ে বেরিয়েছিল?’
‘সেটা পোস্ট-মর্টেম না হওয়া পর্যন্ত জানা যাবে না। কিন্তু যেদিক দিয়েই গুলি ঢুকুক, ব্যালকনিতে গুলিটা পাওয়া যায়নি। তা থেকে অনুমান করা অন্যায় হবে না যে, বাসার ভিতর দিক থেকেই অনাদি হালদারকে গুলি করা হয়েছে।’
‘আচ্ছা, তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক যে, বাসার ভিতর থেকেই কেউ গুলি চালিয়েছে। কিন্তু লোকটা কে?’
‘সেইটেই আসল প্রশ্ন। দেখা যাক কার স্বাৰ্থ আছে। কেষ্ট দাসের কোনও স্বার্থ আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। কিন্তু লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত এবং পাজি, হয়তো দোষ কাটাবার জন্যেই শেষ রাত্রে আমার কাছে ছুটে এসেছিল। সুতরাং তাকেও বাদ দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় হল ননীবালা দেবী। ‘
‘ননীবালা?’
‘ননীবালা দেবীটি জবরদস্ত মহিলা। পালিত পুত্রের প্রতি তাঁর স্নেহ খাঁটি মাতৃস্নেহের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। তিনি জানতেন না যে প্ৰভাতের পোষ্যপুত্র গ্রহণের ব্যাপারে আইনঘটিত খুঁত আছে। সুতরাং তিনি ভাবতে পারেন যে অনাদি হালদারকে সরাতে পারলেই প্রভাত সম্পত্তি পাবে। এবং তাকে মারবার চেষ্টা আর কেউ করবে না। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, ননীবালা যেদিন দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, সেদিন আমি বলেছিলাম, অনাদি হালদারের মৃত্যুতে অনেকের সুবিধে হতে পারে। হয়তো সেই কথাটাই ননীবালার প্রাণে গেথে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু–মেয়েমানুষ বন্দুক চালাবে?’
‘কোন চালাবে না? বন্দুক চালানোর মধ্যে শক্তটা কোনখানে? হারমোনিয়াম যেমন টিপলেই সুকুর, কৰ্ম্মক তেমনি টিপলেই গুলি বোঝায়। ওর চেয়ে কুমড়ো-ছেচকি রাঁধা ঢের বেশি কঠিন কাজ।’
‘কিন্তু ননীবালা তো ‘জয় মা কালী দেখছিলেন।’
‘তিনি ‘জয় মা কালী’ দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সারাক্ষণ প্রেক্ষাগৃহে ছিলেন, তার প্রমাণ কৈ? তাঁর সঙ্গে পরিচিত কেউ ছিল না, হয়তো ছবি আরম্ভ হবার পর তিনি অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়েছিলেন, তারপর কাজকর্ম সেরে আবার গিয়ে বসেছিলেন।’
‘তিনি বন্দুক কোথায় পেলেন?’
‘হায় মুর্খ! বাঁটুল সদারের মত গণ্ডাগণ্ডা গুণ্ডা যেখানে চোরাই বন্দুক পাচার করবার জন্যে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, সেখানে বন্দুকের অভাব? পাঁচ টাকা খরচ করলে বন্দুক ভাড়া পাওয়া যায়।’
‘হুঁ। তারপর?’
‘তারপর প্রভাত। প্ৰভাত অবশ্য জানত যে সে অনাদি হালদারের পুষ্যিপুত্তুর নয়, কিন্তু তার অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তার নিজস্ব দোকান আছে, অনাদি হালদার মরে গেলেও তার মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। সে ভাবতে পারে অনাদি হালদারের মৃত্যুর পর তার ভাইপোরা আর তার কোনও অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে না। ভাইপোদের হাত থেকে নিজের প্ৰাণ বাঁচাবার জন্যেই হয়তো সে অনাদি হালদারকে মেরেছে।’
‘এটা খুব জোরালো মোটিভ তুমি মনে করা?’
‘খুব জোরালো মোটিভ না হতে পারে, কিন্তু তিল কুড়িয়ে তাল হয়। প্ৰভাত একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, অনাদি হালদার সে সম্বন্ধ ভেঙে দেয়। এটাও সামান্য মোটিভ নয়।’
আমি হাসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘হেসো না। তোমার কাছে যা তুচ্ছ, অন্যের কাছে তা পর্বতপ্ৰমাণ হতে পারে। কখনও প্রেমে পড়নি, প্রেম কি বস্তু জান না। প্রেমের জন্যে মানুষ খুন করতে পারে, ফাঁসি যেতে পারে, সর্বস্ব খোয়াতে পারে—‘
‘আচ্ছা, আচ্ছা, মেনে নিলাম প্ৰভাতও খুন করতে পারে।’
‘তবে একটা কথা আছে। প্রভাত সারাক্ষণ তার দোকানে ছিল, দোকানের দরজায় গুর্খা দরোয়ান ছিল। তার এই অ্যালিবাই যদি পাকা হয়—‘
‘পাকা হওয়াই সম্ভব। প্ৰভাত এমন মিথ্যে কথা বলবে না। যা সহজেই ধরা যায়। তারপর বল। ‘
‘তারপর ন্যাপা।’ ব্যোমকেশ পকেট হইতে কুড়াইয়া পাওয়া চাবিটি বাহির করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিল, ‘দুটো খবর নিশ্চয়ভাবে জানা দরকার : এটা অনাদি হালদারের চাবি কিনা এবং এটা গলিতে কে ফেলেছিল।’
বলিলাম, ন্যাপার ওপরই তোমার সন্দেহ, কেমন? মনে করা যাক, এটা অনাদি হালদারের আলমারির চাবি এবং ন্যাপা এটা গলিতে ফেলেছিল। তাতে কী প্ৰমাণ হয়?’