আদিম রিপু

‘প্ৰমাণ হয়তো কিছুই হয় না‌, কিন্তু ন্যাপার ওপর সন্দেহ হয়। আলমারিতে হয়তো অনেক নগদ টাকা ছিল–’

এ আবার এক নূতন সম্ভাবনা। প্রশ্ন করিলাম‌, ‘দাঁড়ালো কি? আসামী কে? নিমাই নিতাই? কেষ্টবাবু? ননীবালা? প্ৰভাত? ন্যাপা? না আর কেউ?’

‘আর একজন হতে পারে।’

‘আবার কে?’

‘বাঁটুল সর্দার।’

‘বাঁটুল! সে কেন অনাদি হালদারকে খুব করবে?’

‘প্রাণরক্ষার ওজুহাতে চাঁদা আদায় করা বাঁটুলের পেশা। অনাদি হালদার চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেছিল। তার দেখাদেখি যদি অন্য সকলে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে? তাই অনাদি হালদারকে শাস্তি দেওয়া দরকার‌, তার পরিণাম দেখে আর সকলে শায়েস্তা থাকবে।’

পুঁটিরাম আসিয়া চায়ের পেয়ালা তুলিয়া লইয়া গেল। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল‌, ‘বাঁশি বনে ডোম কানা। শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী করে রেখে করে ফেলি।’

দুইজনে নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। ঘড়িতে যখন সওয়া চারটে‌, তখন দ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল।

দ্বার খুলিয়া দেখিলাম কেষ্টবাবু। শেষ পর্যন্ত কেষ্টবাবু আসিয়াছেন। কিন্তু এ কেষ্টবাবু সকালবেলার ভয়বিমূঢ় মদ্যবিহ্বল কেষ্টবাবু নয়‌, চটপটে স্মার্ট কেষ্টবাবু। গায়ে ধোপদূরস্ত জামাকাপড়‌, দস্তুর মুখে আত্মপ্রসন্ন মৃদুমন্দ হাসি। মানুষটা যেন আগাগোড়া বদলাইয়া গিয়াছে।

তিনি ব্যোমকেশের সম্মুখের চেয়ারে উপবিষ্ট হইলেন। ব্যোমকেশ চাবিটি হাতে তুলিয়া ধরিয়া নিবিষ্ট মনে নিরীক্ষণ করিতেছিল‌, চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘খবর কি? পুলিস এসেছিল?’

কেষ্টবাবু চাবিটি দেখিলেন, কিন্তু তাঁহার মুখে-চোখে কোনও প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পাইল না। প্রশ্নের উত্তরে তিনি মুখে চটকার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘এগারোটার সময় এসেছিল। কী রামরাজত্বে বাস করছি আমরা।‘

চাবি পকেটে রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তারপর কি হল?’

‘কি আর হবে। দারোগী সকলকে হুমকি দিলে, অনাদির আলমারিটা খুলে দেখলে, একগোছা নোট ছিল পকেটে পুরলে, তারপর লাশ তুলে নিয়ে চলে গেল।‘

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গুম হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আপনাদের কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে না?’

‘কাল রাত্রে কে কোথায় ছিলাম জিজ্ঞেস করেছিল, আর কিছু নয়। একছত্র লিখেও নিলে না। দুম দুম করে এল, দুম দুম করে চলে গেল।‘

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক, অনাদি হালদারের বেশ সদগতি হল। কে মেরেছে তা জানা যাবে না, পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ভালই হল, আপনাদের ভুগতে হবে না।‘

কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘ভাল যাদের হবার তাদের হল, আমার আর কি ভাল হল, ব্যোমকেশবাবু? আমাকে বেশিদিন ওখানে টিকতে হবে না।’

‘কেন?’

‘ননীবালা পেছনে লেগেছে, আমাকে তাড়াতে চায়। এখন তো আর অনাদি নেই, মাগীর বিক্রম বেড়েছে। দেখুন না, বেরুবার সময় বললাম, এক পেয়ালা চা করে দেবে? তা মুখ-ঝামটা দিয়ে উঠল, চা-টা এখন হবে না, দোকানে গিয়ে চা খাওগে।‘

ক্ষণেক নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে আপনি এখন কি করবেন মনে করেছেন?’

‘কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কাজকর্ম তো আর এ-বয়সে পোষাবে না।’ বলিয়া কেষ্টবাবু দুই সারি দাঁত বাহির করিয়া হাসিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার বয়স এমন কী বেশি হয়েছে।–কাজ করবার বয়স যায়নি।’

‘কাজ করার অভ্যোস ছেড়ে গেছে, ব্যোমকেশবাবু। হ্যা হ্যা, আচ্ছা, আজ উঠি তাহলে।‘ বলিয়া তিনি গাত্ৰোত্থান করিলেন।

‘বসুন, বসুন, চা খেয়ে যান।‘

কেষ্টবাবু আবার বসিয়া পড়লেন। ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে ডাকিয়া চা ও জলখাবার আনিতে কেষ্টবাবু হৃষ্টমুখে বলিলেন, “আপনি ভদ্রলোক, তাই দরদ বুঝলেন। সবাই কি বোঝে? দুনিয়া স্বার্থপর, গলা টিপে না ধরলে কেউ কিছু দেয় না। অনাদি যে আমাকে একেবারে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে—‘ তিনি ব্যোমকেশের পানে আড়নয়নে চাহিলেন, ‘চা খুবই ভাল জিনিস, তবে কি জানেন, আমার একটা বদঅভ্যোস হয়ে গেছে, বিকেলবেলার দিকে শুধু চায়ে আর মৌতাত জমে না।‘ বলিয়া হ্যা হ্যা করিয়া হাসিলেন।

ইঙ্গিতটা ব্যোমকেশ এড়াইয়া গেল। বলিল, ‘পুলিস ছাড়া আর কেউ এসেছিল নাকি? নিমাই নিতাই?’

কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘নিমাই নিতাই আর আসেনি। তবে গুরুদত্ত সিং এসে খানিকটা চেঁচামেচি করে গেল।’

‘গুরুদত্ত সিং, কনট্রাকটর—‘

‘হ্যাঁ। পুলিস চলে যাবার পরই সে এসে হাজির। চেঁচাতে লাগল, আমি পঞ্চাশ হাজার টাকার কাজ করেছি, মোটে ত্ৰিশ হাজার পেয়েছি, আজ অনাদি হালদার দশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল, সে মরে গেছে, এখন কে দেবে টাকা। আমি বললাম, বাপু, কে টাকা দেবে তা আমরা কি জানি। অনাদির ওয়ারিশের কাছে যাও, থানায় যাও, আদালতে যাও, এখান থেকে বিদেয় হও। যেতে কি চায়? অনেক কষ্টে বিদেয় করলাম।’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল‌, ‘অনাদি হালদার কনট্রাকটরকে আজ দশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল.কাল ছিল ব্যাঙ্ক-হলিডে‌, তার মানে পরশু ব্যাঙ্ক থেকে টাকা এনে রেখেছিল‌, অর্থাৎ–‘

কেষ্টবাবু বলিলেন‌, ‘ব্যাঙ্ক থেকে?’

‘হ্যাঁ‌, ব্যাঙ্ক থেকে ছাড়া অত টকা কোথা থেকে আসবে?’

কেষ্টবাবু সুর পাল্টাইয়া বলিলেন‌, ‘তা তো বটেই। আমি ওসব কিছু জানি না। আদার ব্যাপারী, হ্যা হ্যা—‘

ব্যোমকেশ তখন বলিল‌, ‘ওকথা থাক। আপনি ওদের ঘরের লোক‌, নাড়ির খবর রাখেন‌, কে খুন করেছে আন্দাজ করতে পারেন না?’

কেষ্টবাবু কিয়াৎকোল নতনেত্ৰে থাকিয়া চোখ তুলিলেন‌, ‘আপনাকে ধৰ্ম্মকথা বলব‌, বাড়ির কেউ এ-কাজ করেনি।’

‘কারুর ওপর আপনার সন্দেহ হয় না?’

‘সন্দেহ সকলের ওপরেই হয়‌, কিন্তু বিশ্বাস হয় না। এ ওই ভাইপো দুটোর কাজ। ভেবে দেখুন‌, বাড়ির লোকের অন্যদিকে মেরে লাভ কি? সকলেই ছিল অনাদির অন্নদাস। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে‌, দুদিন বাদে হাঁড়ি চড়বে না।’

0 Shares