আদিম রিপু

‘হাঁড়ি চড়বে না কেন? নৃপেন মাইনের চাকর ছিল‌, সে অন্যত্র চাকরি খুঁজে নেবে। আর প্ৰভাত? তার তো দোকান রয়েছে।’

‘দোকান থাকবে কি? ভাইপোরা মোকদ্দমা করে কেড়ে নেবে।’

‘যদি কেড়েও নেয়‌, তবু ওদের অন্নাভাব হবে না। প্ৰভাত আর কিছু না পারুক‌, দপ্তরীর কাজ করে নিজের পেট চালাতে পারবে।’

‘দপ্তরীর কাজ।’ কেষ্টবাবু চকিতে চোখ তুলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন।

‘আপনি জানেন না? প্ৰভাত দপ্তরীর কাজ জানে‌, ছেলেবেলায় দপ্তরীর দোকানে কাজ শিখেছে।’

পুঁটিরাম চা ও জলখাবার লইয়া আসিল। কেষ্টবাবু জলখাবারের রেকবি তুলিয়া লইয়া আহারে মন দিলেন‌, কিন্তু তাঁহার চক্ষু দু’টি অন্তর্নিবিষ্ট হইয়া রহিল। একবার শুধু অস্ফুট স্বরে বলিলেন‌, ‘কি আশ্চর্য! আমি জানতাম না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না-জানা আর আশ্চর্য কী! দপ্তরীর কাজ এমন কিছু মহৎ কাজ নয় যে কেউ ঢাক পেটাবে।’

কেষ্টবাবু একবার ধূর্ত চক্ষু তুলিয়া বলিলেন‌, ‘তা বটে।’

পানাহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ তাঁহাকে সিগারেট দিয়া বলিল‌, ‘আজ সকালে আপনি বলেছিলেন‌, অনাদি হালদারের সব গুপ্তকথা। আপনি জানেন‌, ইচ্ছে করলে তাঁকে ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারেন—‘

কেষ্টবাবু ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, ‘গুপ্তকথা! না না‌, আমি অনাদির গুপ্তকথা কেখেকে জািনব? মদের মুখে কি বলেছিলাম তার কি কোনও মনে হয়? আচ্ছা‌, আজ চললাম‌, অসংখ্য ধন্যবাদ।’ তিনি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন।

ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল‌, ‘শুনুন‌, কেষ্টবাবু-তিনি দ্বারের কাছে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন‌, ‘গুপ্তকথা না বলতে চান না বলবেন‌, আমার বেশি আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ রাত্তিরে এখানে খাওয়া-দাওয়া করতে তো দোষ নেই। ওখানে হয়তো আজ। আপনার খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হবে—‘

কেষ্টবাবু সাগ্রহে দুই পা অগ্রসর হইয়া আসিলেন‌, ‘খাওয়া-দাওয়া—!’

‘হাঁ। আপনার খাতিরে আজ না-হয় একটু তরল পদার্থের ব্যবস্থা করা যাবে।’

‘সত্যি বলছেন। আপনারও। তাহলে অভ্যোস আছে। মোদ দিদিমণি না জানতে পারে‌, কেমন? হ্যা হ্যা। ক’টার সময় আসব বলুন।’

‘সন্ধ্যের পরই আসবেন। আমাকে বোধহয় একবার বেরুতে হবে। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন‌, যদি ফিরতে দেরি হয় চাকরি আপনাকে বসাবে।’

‘বেশ বেশ‌, আমি সন্ধ্যার পরই আসিব।’ দ্ৰংষ্ট্রাবিকট হাস্য করিতে করিতে তিনি প্ৰস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ আমার প্রতি চোখ নাচাইয়া বলিল‌, ‘সাদা চোখে কেষ্ট দাস কিছু বলবে না। —অজিত‌, তুমি শুড়ি বাড়ি যাও‌, একটি পাঁট বোতল কিনে নিয়ে এস। নাসিক হুইস্কি হলেই চলবে। এদিকে আমি পুঁটিরামকে তালিম দিয়ে রাখছি।’

১০

পাঁচটার সময় দুইজনে বাহির হইলাম।

পুঁটিরামকে তালিম দেওয়া হইয়াছে। বসিবার ঘরে টেবিলের উপর বোতল কর্ক-স্কু ও কাচের গেলাস রাখা হইয়াছে। বাহিরের দ্বারে কড়া নাড়িলে পুঁটিরাম আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিবে এবং ভেট্‌কি মাছের মত মুখ দেখিলে বলিবে—’আসুন বাবু্‌, কর্তারা বেরিয়েছেন‌, এখুনি ফিরবেন।’ ভেট্‌কি মাছকে টেবিলের নিকট বসাইয়া পুঁটিরাম ডিম ভাজিয়া আনিয়া দিবে এবং নিজে গা-ঢাকা দিবে। তারপর—‘

ফুটপাথে নামিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কোথায় চলেছি আমরা?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থান নেই। কেষ্ট দাস এসে বোতল সাবাড় করবে তারপর আমরা ফিরব।’

‘তা বুঝেছি। কিন্তু ততক্ষণ করব কী?’

‘ততক্ষণ চল গোলদীঘিতে বায়ু সেবন করা যাক।’

গোলদীঘিতে গিয়া পাক খাইতে লাগিলাম। বেশি কথাবার্তা হইল না; ব্যোমকেশ একবার বলিল‌, ‘কেষ্ট দাস গলিতে চাবি ফেলেনি।’

এক সময় চোখে পড়িল য়ুনিভারসিটি ইনস্টিট্যুটে অনেক লোক প্রবেশ করিতেছে‌, বোধহয় কোনও অনুষ্ঠান আছে। ঘুরপাক খাইয়া খাইয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, ব্যোমকেশকে বলিলাম, ‘চল না‌, দেখা যাক ওখানে কি হচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল। সম্ভবত কোনও বিখ্যাত লোকের মৃত্যু উপলক্ষে উৎসবসভা বসেছে।’

য়ুনিভারসিটি ইনস্টিট্যুটে প্রবেশ করিতে গিয়া ইন্দুবাবুর সহিত দেখা হইয়া গেল। তিনি সিনেমার লোক‌, তার উপর সঙ্গীতজ্ঞ‌, অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসিয়াছেন। ব্যোমকেশের অনুমান মিথ্যা নয়‌, সিনেমার এক দিকপালের মৃত্যুবাসরে তাঁহার সহধর্মীরা নৃত্য গীত দ্বারা শোক প্রকাশ করিতেছেন। ইন্দুবাবুর সহিত ব্যোমকেশের পরিচয় করাইয়া দিলাম। তিনি আমাদের লইয়া গিয়া সামনের দিকের একটা সারিতে বসাইয়া দিলেন‌, নিজেও পাশে বসিলেন।

মঞ্চের উপর কয়েকটা পদায়-দেখা মুখ চোখে পড়িল‌, অন্য মুখও আছে। সভাপতি একজন পলিতকেশ চিত্রাভিনেতা।

মঞ্চস্থ লোকগুলির মধ্যে একটি মেয়ের মুখ বিশেষ করিয়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। অপরিচিত মুখ; সুন্দর নয়‌, কিন্তু চিত্তাকর্ষক। তন্বী নয়‌, পূর্ণাঙ্গী‌, রঙ ফর্সা বলা চলে‌, একরাশ চুল ঘাড়ের কাছে কুণ্ডলিত হইয়া লুটাইতেছে। যাহাকে যৌন আবেদন বলা হয়‌, যুবতীর তাহা প্রচুর পরিমাণে আছে। একটি ষণ্ড গোছের যুবক তাহার গা ঘোষিয়া বসিয়া আছে এবং মাঝে মাঝে তাহার কানে কানে কথা বলিতেছে।

যে গানটা চলিতেছিল তাহা শেষ হইল। সভাপতি একটি চিরকুট হাতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন‌, ‘এবার কুমারী শিউলী মজুমদার গাইবেন—কোথা যাও ফিরে চাও দূরের পথিক।’

যে যুবতীকে আমি লক্ষ্য করিয়াছিলাম তাঁহারই নাম শিউলী মজুমদার। সে সংযত মন্থরপদে সম্মুখে আসিয়া উপবেশন করিল‌, ষণ্ডা যুবক বাঁয়োতবলা লইয়া বসিল। গান আরম্ভ হইল।

গলাটি মিষ্ট‌, নিটোল‌, কুহক-কলিত। চোখ বুজিয়া শুনিতে লাগিলাম। তারপর ব্যোমকেশের কনুইয়ের গুঁতা খাইয়া চমক ভাঙিল। ব্যোমকেশ কানে কানে বলিল‌, ‘ওহে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখ।’

0 Shares