আদিম রিপু

বাঁ দিকে সন্তৰ্পণে চক্ষু ফিরাইলাম। কয়েকখানা চেয়ার বাদে প্রথম সারিতে প্রভাত বসিয়া আছে। তন্ময় সমাহিত মুখের ভাব‌, একাগ্র দৃষ্টি গায়িকার উপর বিন্যস্ত। প্রভাত বোধহয় আমাদের দেখিতে পায় নাই‌, পাইলে এতটা একাগ্ৰ হইতে পারিত না। ব্যোমকেশের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম মুখে একটু বাঁকা হাসি লইয়া সে গান শুনিতেছে।

আমার মাথার মধ্য দিয়া বিদ্যুৎ চমকিয়া গেল। শিউলী মজুমদার‌, যাহাকে প্রভাত বিবাহ করিতে চাহিয়াছিল‌, এ কি সেই?…

শিউলী মজুমদারের গান শেষ হইল। তারপর আরও কয়েকজন গাহিলেন। লক্ষ্য করিলাম‌, শিউলী মজুমদারের গান শেষ হইবার পর প্রভাত অলক্ষিতে উঠিয়া গেল।

সভা শেষ হইবার পূর্বে আমরাও উঠিলাম। ইন্দুবাবু আমাদের সঙ্গে দ্বার পর্যন্ত আসিলেন।

ব্যোমকেশ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ওই শিউলী মজুমদার নামে মেয়েটি-খাসা গায়। ও কি সিনেমার মেয়ে?’

ইন্দুবাবু বলিলেন‌, ‘না‌, এখনও ঢোকেনি। তবে গদানন্দ যখন জুটেছে তখন আর দেরি নেই।‘

‘গদানন্দ?’

‘ওই যে তবলা বাজাচ্ছিল। লোকটা সিনেমার দালাল। ভদ্রঘরের মেয়েদের গান বাজনা শেখানো ওর পেশা‌, কিন্তু জুৎসই মেয়ে পেলে সিনেমায় টেনে নিয়ে যায়।’

‘তাই নাকি! ওরা সত্যি নাম গদানন্দ?’

‘নাম জগদানন্দ। সিনেমায় সবাই গদানন্দ বলে। অনেক মেয়ের মাথা খেয়েছে।’

‘শিউলীর বাপের নাম আপনি জানেন?’

‘নামটি যেন শুনেছিলাম‌, হ্যাঁ‌, দয়ালহরি মজুমদার। সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে।’

বাসায় ফিরিলাম সাতটার সময়।

দরজা ভেজানো ছিল‌, প্রবেশ করিয়া দেখিলাম কেষ্টবাবু তক্তপোশের উপর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়াছেন‌, ডান হাতের তর্জনীকে বন্দুকে পরিণত করিয়া ঘরের কোণে লক্ষ্য স্থির করিতেছেন। মদের বোতলটা শূন্য উদরে এক পাশে পড়িয়া আছে। কেষ্টবাবু আমাদের প্রবেশ জানিতে পরিলেন না‌, ঘরের উর্ধ কোণ তাক করিয়া বন্দুক ছুঁড়িলেন-গুডুম—ফিস।’

আওয়াজটা অবশ্য তিনি মুখেই উচ্চারণ করিলেন।

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘কেষ্টবাবু্‌, কি হচ্ছে?’

কেষ্টবাবু বলিলেন‌, ‘চুপ‌, পাখি উড়ে যাবে। — গুডুম—ফিস।’

ব্যোমকেশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল‌, ‘ও‌, পাখি শিকার করছেন। তা কটা পাখি মারলেন?’

কেষ্টবাবু বন্দুক নামাইয়া সহজভাবে বলিলেন‌, ‘তিনটে হর্তেল ঘুঘু মেরেছি।’ তাঁহার শিথিল মুখমণ্ডলে একটু তৃপ্তির হাসি খেলিয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ বেশ। কিন্তু গুডুম-ফিস্ কেন? গুড়ুম না হয় বুঝলাম‌, ফিস কী?’

কেষ্টবাবু বলিলেন‌, ‘ফিস বুঝলেন না? গুডুম করে বন্দুকের আওয়াজ হল‌, আর ফিস করে পাখির প্রাণ বেরিয়ে গেল।’

কেষ্টবাবু শয়ন করিলেন। দেখিলাম তিনি ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।

ঘণ্টা দেড়েক পরে তাঁহার ঘুম ভাঙাইলাম‌, তারপর আহার শেষ করিয়া আবার তক্তপোশে আসিয়া বসিলাম। কেষ্টবাবুর অবস্থা এখন অনেকটা ধাতস্থ, পক্ষী শিকারের আগ্রহ আর নাই।

কেষ্টবাবুকে সিগারেট দিয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল‌, ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল‌, ‘কেষ্টবাবু্‌, আপনাকে দেখে মনে হয় বয়সকালে আপনি ভারি জোয়ান ছিলেন।’

কেষ্টবাবু মাথাটি নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন‌, ‘কী শরীর যে ছিল ব্যোমকেশবাবু্‌, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ইয়া ছাতি‌, ইয়া হাতের গুলি; একটা আস্ত পাঁঠা একলা খেয়ে ফেলতে পারতাম। লোকে ডাকতো-ভীম কেষ্ট।’

‘নিশ্চয় খুব মারামারি করতেন? অনেক সায়েব ঠেঙিয়েছেন?’ ‘সায়েব কি বলছেন‌, জাহাজী গোরা পর্যন্ত ঠেঙিয়েছি। ব্যাটারা মদ খাবার জন্যে জাহাজ থেকে নামত। গলিখুঁজিতে ঘুরে বেড়াত। আমি ওৎ পেতে থাকতাম‌, কাউকে একলা পেলে দু’ চার ঘা দিয়েই লম্বা। হ্যা হ্যাঁ।’

‘আপনি দেখছি আমার মনের মতন মানুষ।–আচ্ছা‌, কখনও মানুষ খুন করেছেন?’ ব্যোমকেশ অন্তরঙ্গভাবে তাঁহার পাশ ঘোষিয়া বসিল।

‘মানুষ খুন–!’ কেষ্টবাবু ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে তাকাইলেন।

‘আরো মশাই‌, ভয় কিসের? ইয়ার বন্ধুর কাছে বলতে দোষ কি? এই তো আমি তিনটে মানুষ খুন করেছি। অজিত জানে‌, ওকে জিজ্ঞেস করুন।’

কেষ্টবাবু আশ্বস্তত হইলেম–ঠিক নিজের হাতে খুন করিনি‌, তবে দলে ছিলাম। ওই ‘অনাদিটা—‘

‘অনাদি হালদারের সঙ্গে বুঝি আপনার অনেক দিনের পরিচয়?’

‘ইস্কুল থেকে। অনাদিটা ছিল পগেয়া শয়তান। কিন্তু গায়ে জোর ছিল না‌, তাই আমাকে দলে টানত। আমি ইস্কুলে ভাল ছেলে ছিলাম মশাই‌, ওই অনাদির পাল্লায় পড়ে বিগড়ে গেলাম।’

‘তারপর?’

‘একটা ডেপুটির ছেলে সাইকেল চড়ে ইস্কুলে আসত। একদিন আমি আর অনাদি সাইকেল নিয়ে সটকান্‌ দিলাম‌, চোরাবাজারে দিলাম বেচে। কিন্তু ডেপুটির ছেলের সাইকেল‌, পুলিস লাগল। ধরা পড়ে গেলাম। হেডমাস্টার দু’জনকে রাস্টিকেট করে দিলে।’

‘ঐ তো। হেডমাস্টারগুলো বড় পাজি হয়। —তারপর কি হল?’

‘তারপর আর কি! নাম কাটা সেপাই! বছর দুই পরে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হল। আর আমাদের পায় কে? একেবারে মেসোপটেমিয়া। বাসরা…কুট্‌ এল-আমারা–ভারি ফুর্তিতে কেটেছিল কটা বছর।’

‘সেই সময় বুঝি রাইফেল চালাতে শিখেছিলেন?’

‘হ্যাঁ। অব্যৰ্থ টিপ ছিল। কুট্‌-এল্‌-আমরায় যখন আটকা পড়েছিলাম তখন আমাদের রসদে টান পড়েছিল‌, ঘোড়ার মাংস খেতে হয়েছিল। তখন আমি রাইফেল দিয়ে উড়ন্ত পাখি শিকার করতাম। ক্যাপ্টেন আমার নাম দিয়েছিল—উইলিয়াম টেল্‌! সে একদিন ছিল।’ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘যুদ্ধের পর দেশে ফিরে এলাম। আবার পুনর্মুষিক…তার কিছুদিন পরে অনাদি এক কাণ্ড করে বসল। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে ব্যাপকে ঠেঙিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাল। এমন ঠেঙিয়েছিল যে বাপটা পরের দিনই টেঁসে গেল। বাড়ির লোকেরা অবশ্য ব্যাপারটা চাপাচুপি দিয়ে দিল কিন্তু অনাদি সেই যে পালাল‌, পাঁচ বছর আর তার দেখা নেই।

0 Shares