‘পাঁচ বছর পরে একদিন গভীর রাত্রে অনাদি চুপিচুপি আমার কাছে এসে হাজির। বললে-ব্যবসা করবি তো চল আমার সঙ্গে, খুব লাভের ব্যবসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম-কিসের ব্যবসা? কোথায় যেতে হবে? সে বললে-বেহারের একটা ছোট্ট শহরে। মারোয়াড়ীর সঙ্গে ব্যবসা। একলা সে ব্যবসা হয় না। তাই তোকে নিতে এসেছি। রাতারাতি বরাত ফিরে যাবে। যাবি তো চল। —আমার তখন সময়টা খারাপ যাচ্ছে, রাজী হয়ে গেলাম।
‘বেহারের নগণ্য একটা জায়গা, নাম লালনিয়া। সামনে দিয়ে রেলের লাইন গেছে। পিছন দিকে পাহাড় আর জঙ্গল। আমরা ইস্টিশানে নেমে শহরে গেলাম না, দিনের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রইলাম। সেখানে অনাদি আসল কথা খুলে বলল—শহরের একটরে জঙ্গলের গা ঘেঁষে এক মারোয়াড়ীর গদি আছে, বুড়ো মারোয়াড়ীটা রাত্তিরে একলা থাকে। বুড়োর অনেক টাকা, গদিতে ডাকাতি করতে হবে।
‘দুপুর রাত্রে মারোয়াড়ীর গদিতে গেলাম। আমার হাতে লোহার ডাণ্ডা; অনাদির হাতে ইলেকক্ট্রিক টর্চ, কোমরে ভোজালি। মারোয়াড়ীটা চোরাই মালের কারবার করত, রাত্রে চোরেরা তার কাছে আসত। অনাদি দরজায় টোকা দিতেই সে দরজা খুলে দিলে, আমি লাগালাম তার মাথায় এক ডাণ্ডা। বুড়োটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
‘গদি লুঠ করলাম। বেশি কিছু পাওয়া গেল না, হাজার তিনেক নগদ আর কিছু সোনার গয়না। তাই নিয়ে বেরুচ্ছি, মারোয়াড়ীটা দোরগোড়ায় পড়েছিল, হঠাৎ অনাদির ঠ্যাং জড়িয়ে ধরল। অনেক ধস্তাধস্তি করেও অনাদি ঠ্যাং ছাড়াতে পারল না, মারোয়াড়ী মরণকামড়ে কামড়ে ধরেছে। তখন সে কোমর থেকে ভোজলি বার করে মারল বুড়োর ঘাড়ে এক কোপ। বুড়োটা ক্যাঁক করে মরে গেল।
‘রক্তমাখা ভোজালি সেইখানে ফেলে আমরা পালালাম। শেষরাত্ৰে ইস্টিশানে গিয়ে ট্রেন ধরলাম; লুঠের মাল অনাদির কাছে ছিল; সে বলল-তুই এক গাড়িতে ওঠ, আমি অন্য গাড়িতে উঠি। দু’জনে এক কামরায় উঠলে কেউ সন্দেহ করতে পারে। উঠে পড়, উঠে পড়, পরের স্টেশনে আবার দেখা হবে। আমি একটা কামরায় উঠে পড়লাম, অনাদি পাশের কামরায়।
‘ব্যাস, সেই যে অনাদি লোপাট হল, বিশ বছরের মধ্যে আর তার টিকি দেখতে পেলাম না-বেইমান! বিশ্বাসঘাতক।’
পুরাতন টাকার শোকে কেষ্টবাবু ফুঁসিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে আর একটি সিগারেট দিয়া বলিল, ‘অনাদি হালদার বেইমান ছিল তাই তো তার আজ এই দুরবস্থা। কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন। ইচ্ছে করলে অনাদিকে ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারেন। তার মানে কি? তাকে ফাঁসাতে গেলে আপনি নিজেও যে ফেঁসে যেতেন।’
কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘মারোয়াড়ী-খুনের ব্যাপারে খুব হৈ চৈ হয়েছিল, কাগজে লেখালেখি হয়েছিল। পুলিস ভোেজালির গায়ে অনাদির আঙুলের ছাপ পেয়েছিল। কিন্তু অনাদিকে তো তারা চেনে না, তাকে ধরবে কি করে? একমাত্র আমি জানতাম। আমি যদি পুলিসকে একটি বেনামী চিঠি ছাড়তাম-লালনিয়ার খুনীর নাম অনাদি হালদার, সে অমুক ঠিকানায় থাকে, আঙুলের ছাপ মিলিয়ে নাও—তাহলে কী হত?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝেছি। তারপর আবার কবে অনাদি হালদারকে পেলেন?’
কেষ্টবাবু্, দন্তপংক্তি কোষমুক্ত করিলেন—’বছর দুই আগে, এই কলকাতা শহরে। ফুটপাথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি অনাদি বৌবাজারের বাসায় ঢুকেছে। আর যাবে কোথায়? খোঁজখবর নিয়ে জানলাম অনাদি পয়সা করেছে, দুধে-ভাতে আছে। একবার ভাবলাম, দিই পুলিসকে বেনামী চিঠি। কিন্তু আমার সময়টা তখন খারাপ যাচ্ছে-একদিন গিয়ে দেখা করলাম। অনাদি ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল। আমি বললাম-আজ থেকে আমাকেও দুধে-ভাতে রাখতে হবে, নইলে লালনিয়ার মারোয়াড়ীকে কে খুন করেছে পুলিস জানতে পারবে। খুনের মামলা তামাদি হয় না।’
রাত হইয়া গিয়াছিল, কেষ্টবাবু আমাদের তক্তপোশেই রাত্রি কাটাইলেন।
১১
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিতে দেরি হইল। তাড়াতাড়ি বসিবার ঘরে গিয়া দেখি, ব্যোমকেশ বসিয়া চিঠি লিখিতেছে, কেষ্টবাবু নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শিকারী কোথায়?’
ব্যোমকেশ সহাস্য চোখ তুলিয়া বলিল, ‘রাত না পোয়াতে কখন উঠে পালিয়েছে।’
কাল রাত্ৰে মদের মুখে যে-সব কথা প্রকাশ পাইয়াছে আজ সকালে তাহা স্মরণ করিয়াই বোধহয় কেষ্ট দাস সরিয়াছে।
তক্তপোশে বসিলাম–’সাত সকলে কাকে চিঠি লিখতে বসলে?’
ব্যোমকেশ চিঠিখানা আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া আর একখানা চিঠি লিখিতে আরম্ভ করিল! চিঠি পড়িয়া দেখিলাম–
ভাই রমেশ, এতদিন পরে আমাকে কি তোমার মনে আছে। একসঙ্গে বহরমপুরে পড়েছি। প্রফেসারেরা আমাকে bomb-case বলে ডাকতেন। মনে পড়ছে?
নৃপেন দত্ত নামে একজনের মুখে খবর পেলাম, তুমি তোমার গ্রামেই আছ। নৃপেনকে তুমি চেনো, তোমার পাড়ার ছেলে। তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।
কলকাতায় তোমার আসা যাওয়া নিশ্চয় আছে। একবার এসে না। আমার বাসায়। ঠিকানা দিলাম।
কবে আসছে? ভালবাসা নিও।
ইতি
তোমার পুরনো বন্ধু
ব্যোমকেশ বক্সী
দ্বিতীয় পত্ৰখানি নিমাই-নিতাইকে লেখা–
নিমাইবাবু্, নিতাইবাবু্, শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাসের তেতলার ঘরের কথা জানিতে পারিয়াছি। আমার সঙ্গে অবিলম্বে আসিয়া দেখা করুন, নচেৎ খবরটি পুলিস জানিতে পারিবে।
ব্যোমকেশ বক্সী
আমাকে বলিল, ‘চল, আজ সকালেই বেরুতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘দয়ালহরি মজুমদারের বাসার ঠিকানা মনে আছে তো?
‘১৩/৩, রামতনু লেন, শ্যামবাজার।’
আধা ঘণ্টা পরে আমরা বাহির হইলাম। শ্যামবাজারে গিয়া রামতনু লেন খুঁজিয়া বাহির করিতে সময় লাগিল। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে গলিটি ক্ষুদ্র, দুই ধারের দুইটি বড় রাস্তার মধ্যে যোগসাধন করিয়াছে। আমরা একদিক হইতে নম্বর দেখিতে দেখিতে অগ্রসর হইলাম।