গলির প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছিয়াছি হঠাৎ ও-প্রান্তের একটা বাড়ি হইতে একজন লোক বাহির হইয়া আসিল, ঝড়ের মত আমাদের দিকে অগ্রসর হইল। চিনিলাম প্ৰভাত। সে আমাদের পাশ দিয়া চলিয়া গেল, আমাদের দেখিতে পাইল না। উষ্কখুষ্ক চুল, আরক্ত মুখ-চোখ; আগুনের হল্কার মত সে আমাদের পাশ দিয়া বহিয়া গেল।
আমরা ভ্রূ তুলিয়া পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলাম, তারপর যে দ্বার দিয়া প্রভাত বাহির হইয়াছিল সেই দিকে চলিলাম। নম্বর খুঁজিবার আর প্রয়োজন নাই। ব্যোমকেশ মৃদুগুঞ্জনে বলিল, ‘অনাদি হালদার সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছিল…এখন সে নেই, তাই প্ৰভাত আবার এসেছিল…কিন্তু সুবিধে হল না।’
১৩/৩ নম্বর বাড়ির দরজা বন্ধ। আমরা ক্ষণেক দাঁড়াইয়া ইতস্তত করিতেছি, বাড়ির ভিতর হইতে মেয়েলী গলার গান আরম্ভ হইল। মিষ্ট নিটোল কুহক-কলিত কণ্ঠস্বর, সঙ্গে তবলার সঙ্গত।
ব্যোমকেশ দ্বারে ধাক্কা দিল। ভিতরে গান বন্ধ হইল। একটি প্রৌঢ় ব্যক্তি দ্বার খুললেন। একজোড়া কঠিন চক্ষু আমাদের আপাদমস্তক পরিদর্শন করিল।
‘কি চাই?’লোকটির আকৃতি যেমন বেউড় বাঁশের মত পাকানো, কণ্ঠস্বরও তেমনি শুষ্ক রুক্ষ। একটু পূর্ববঙ্গের টান আছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার নাম কি দয়ালহরি মজুমদার?’
‘হাঁ। কি দরকার?’ ভিতরে প্রবেশ করিবার আহ্বান আসিল না, বরং গৃহস্বামী দুই কবাট ধরিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়াইলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনাদি হালদার মারা গেছে, শুনেছেন বোধহয়। তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই—‘
‘কে অনাদি হালদার! আমি জানি না।’ দয়ালহরিবাবুর শুষ্ক স্বর উগ্ৰ হইয়া উঠিল।
‘জানেন না? তার আলমারিতে আপনার হ্যান্ডনেট পাওয়া গেছে। আপনি পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়েছেন।’
‘কে বলে আমি ধার নিয়েছি! মিথ্যা কথা। কারুর এক পয়সা আমি ধারি না।’
‘হ্যান্ডনেটে আপনার দস্তখত আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘জাল দস্তখত।’ দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ হইয়া গেল।
আমরা কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম, তারপর ফিরিয়া চলিলাম। পিছনে গান ও সঙ্গত আবার আরম্ভ হইল। ভৈরবী একতালা।
ট্রামরাস্তার দিকে চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল, ‘দয়ালহরি মজুমদার লোকটি সামান্য লোক নয়। অনাদি হালদার মরেছে শুনে ভাবছে পাঁচ হাজার টাকা হজম করবে। হ্যান্ডনেটে যে দস্তখত করেছে সেটা হয়তো ওর আসল দস্তখত নয়, বেঁকিয়ে চুরিয়ে দস্তখত করেছে, মামলা যদি আদালতে যায়। তখন অস্বীকার করবে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়; প্রশ্ন হচ্ছে, অনাদি হালদার ওকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিলে কেন?’
বলিলাম, ‘অনাদি হালদারের তেজারাতির ব্যবসা ছিল হয়তো।’
‘তাই বলে বিনা জামিনে শুধু হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধার দেবে! অনাদি হালদার কি এতাই কাঁচা ছেলে ছিল? বানরে সঙ্গীত গায় শিলা জলে ভেসে যায় দেখিলেও না হয় প্রত্যয়।’
‘তবে কি হতে পারে?’
‘জানি না। কিন্তু জানতে হবে।–আমার কি সন্দেহ হয় জানো?’
‘কী? বলিবার জন্য মুখ খুলিয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল। তারপর আকাশের পানে চোখ তুলিয়া বলিল, ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম।’
অতঃপর আমি আর প্রশ্ন করিলাম না।
সেদিন বৈকালে আবার আমরা বাহির হইলাম। এবার গন্তব্যস্থান প্ৰভাতের দোকান।
দোকানের কাছাকাছি পৌঁছিয়াছি, দেখি আর পাঁচজন লোকের মধ্যে বাঁটুল সদার আমাদের আগে আগে চলিয়াছে। প্ৰভাতের দোকানের সামনে আসিয়া বাঁটুলের গতি হ্রাস হইল, মনে হইল সে দোকানে প্রবেশ করবে। কিন্তু প্রবেশ করিবার পূর্বে সে একবার ঘাড় ফিরাইয়া পিছন দিকে চাহিল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হইয়া গেল। অমনি বাঁটুল আবার সিধা পথে চলিতে আরম্ভ করল।
আমি আড়চোখে ব্যোমকেশের পানে তাকাইলাম। তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত, চোয়ালের হাড় শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। আমি মৃদুস্বরে বলিলাম, ‘বাঁটুল কি এবার প্রভাতকে খদ্দের পাকড়াতে চায় নাকি?’
ব্যোমকেশ গলার মধ্যে শুধু আওয়াজ করিল।
দোকানে প্ৰবেশ করিলাম।
খরিদ্দার নাই, কেবল প্ৰভাত কাউন্টারে কনুই রাখিয়া কপালে হাত দিয়া বসিয়া আছে, তাহার মুখ ভাল দেখা যাইতেছে না। আমাদের পদশব্দে সে চোখ তুলিল। চোখ দুইটি জবাফুলের মত লাল। ক্ষণকাল অচেনা চোখে চাহিয়া থাকিয়া সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘আসুন।’
আমরা কাউন্টারের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। পুস্তকালয়ের রাশি রাশি বই আমার মনে মোহ বিস্তার করে, আমি চারিদিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশের ওসব বালাই নাই। সে বলিল, ‘সামান্য একটা কাজে এসেছিলাম। দেখুন তো, এই চাবিটা চিনতে পারেন?’
প্রভাত ব্যোমকেশের হাত হইতে চাবি লইয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল। বলিল, না। কোথাকার চাবি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা আমি জানি না। আপনাদের বাসার পাশে গলিতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।’
‘কি জানি, আমি কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। নতুন চাবি দেখছি। হয়তো রাস্তার কোনও লোকের পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল।’
প্রভাত চাবি ফেরত দিল। ব্যোমকেশ তাহ পকেটে রাখিয়া বলিল, ‘কেষ্টবাবুর খবর কি? তিনি আজ সকালবেলা আপনার বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন।’
প্রভাত ক্ষীণ হাসিল—’হ্যাঁ। কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলেন।’
কোথায় গিয়েছিলেন ব্যোমকেশ তাহা বলিল না, জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেষ্টবাবু তাহলে আপনার স্কন্ধেই রইলেন?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। কি করা যায়? গলাধাক্কা তো দেয়া যায় না।’
‘তা বটে। নৃপেনবাবু কোথায়? চলে গেছেন?’
‘না, এখনও যায়নি। তার দু’মাসের মাইনে বাকি.গরীব মানুষ…ভাবছি। তাকে রেখে দেব। দোকানে একজন লোক রাখলে ভাল হয়, ওকেই রেখে দেব ভাবছি।’