ব্যোমকেশ বলিল, ‘মন্দ কি। আচ্ছা, নিমাই নিতাই বোধহয় আর আসেনি? আলমারি কি পুলিসের পক্ষ থেকে সীল করে দিয়ে গেছে?’
‘না, পুলিস আর আসেনি। তবে অনাদিবাবুর কোমরে যে চাবি ছিল সেটা তারা নিয়ে গেছে। আলমারির বোধহয় ঐ একটাই চাবি ছিল।’
‘তা হবে। আচ্ছা, আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। দয়ালহরি মজুমদার নামে একজনকে অনাদি হালদার পাঁচ হাজার টাকা ধার দিয়েছিল। আপনি জানেন?’
প্রভাত কিছুক্ষণ অবিশ্বাস-ভরা বিহ্বল চক্ষে চাহিয়া রহিল–’পাঁচ হাজার টাকা! আপনি ঠিক জানেন?’
‘অনাদি হালদারের আলমারিতে আমি হ্যান্ডনেট দেখেছি। তাতে দয়ালহরি মজুমদারের সই আছে।’
প্রভাতের শীর্ণ মুখ যেন আরও শুষ্ক ক্লান্ত হইয়া উঠিল, সে অর্ধস্ফুট স্বরে বলিল, ‘আমি জানতাম না। কখনও শুনিনি।’ সে টুলের উপর বসিতে গিয়া স্থানভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়া যাইবার উপক্ৰম করিল। ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া টপ করিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।
‘প্রভাতবাবু! আপনার জ্বর হয়েছে-গা গরম।’
‘জ্বর। না-ও কিছু নয়। ঠাণ্ডা লেগেছে—‘
‘হয়তো বুকে ঠাণ্ডা বসেছে। আপনি দোকানে এলেন কেন? যান, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকুন। ডাক্তার দাকান—’
‘ডাক্তার’ প্রভাত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল–’না না, ওসব হাঙ্গামায় দরকার নেই। আপনিই সেরে যাবে।’
‘আমার কথা শুনুন, কাছেই আমার চেনা একজন ডাক্তার আছেন, তাঁর কাছে চলুন। রোগকে অবহেলা করা ভাল নয়। আসুন।’
প্রভাত আরও কয়েকবার আপত্তি করিয়া শেষে রাজী হইল। দোকানে তালা লাগাইয়া বাহির হইবার সময় ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার গুর্খা দরোয়ানটিকে দেখছি না। তাকে কি ছাড়িয়ে দিয়েছেন?’
প্রভাত বলিল, ‘হ্যাঁ। অনেকদিন দেশে যায়নি, কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমারও আর পাহারাওলার দরকার নেই-–‘ বলিয়া ফিক হাসিল।
দুই তিন মিনিটে ডাক্তার তালুকদারের ডাক্তারখানায় পৌঁছিলাম। তিনি ডাক্তারখানায় উপস্থিত ছিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে আড়ালে লইয়া গিয়া কথাবার্তা বলিল। তারপর তিনি প্রভাতকে ঘরে লইয়া গিয়া টেবিলের উপর শোয়াইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলেন। আমরা সরিয়া আসিলাম।
পরীক্ষার শেষে ডাক্তার আসিয়া বলিলেন, ‘বুকে পিঠে কিছু পেলাম না। তবে স্নায়ুতে গুরুতর শক লেগেছে। একটা ওষুধ দিচ্ছি, এক শিশি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখিতে গেলেন, ব্যোমকেশও তাঁহার সঙ্গে গেল। কিছুক্ষণ পরে ঔষধের শিশি হাতে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, চলুন। ডাক্তারের প্রাপ্য আমি চুকিয়ে দিয়েছি।’
প্রভাত বিব্রত হইয়া বলিল, ‘সে কি, আপনি কেন দিলেন? আমার কাছে টাকা রয়েছে—‘
‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে। এখন চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’
প্ৰভাতের চক্ষু সজল হইয়া উঠিল—’আপনি আমার জন্যে এত কষ্ট করছেন—’
ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল, ‘সংসারে থাকতে গেলে পরস্পরের জন্যে একটু কষ্ট করতে হয়। আসুন।’
ভাড়াটে গাড়িতে প্ৰভাতকে লইয়া আমরা তাহার বাসার উদ্দেশ্যে চলিলাম। ব্যোমকেশের এই পরহিতব্রতের অন্তরালে কোনও অভিসন্ধি আছে কিনা, এই প্রশ্নটা বার বার মনের মধ্যে খোঁচা দিতে লাগিল।
বাসায় পৌঁছিলে ননীবালা দেবী প্ৰভাতের জ্বরের সংবাদ শুনিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন এবং তাহাকে লইয়া গিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিলেন। তিনি অভিজ্ঞ ধাত্রী। ঔষধ-পথ্য সম্বন্ধে তাঁহাকে কিছু বলিতে হইল না। আমরা বিদায় লইলাম।
বাহিরের ঘরে আসিয়া ব্যোমকেশ দাঁড়াইয়া পড়িল। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল, তাহার যাইবার ইচ্ছা নাই। আমি ভ্রূ তুলিয়া প্রশ্ন করিলাম, উত্তরে সে বাম চক্ষু কুঞ্চিত করিল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। নৃপেন প্রবেশ করিল; আমাদের দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল, ‘আপনারা?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রভাতবাবুর শরীর খারাপ হয়েছিল, তাই তাঁকে পৌঁছে দিতে এসেছি।’
‘প্রভাতবাবুর শরীর খারাপ’ নৃপেন ভিতর দিকে পা বাড়াইল।
‘একটা কথা, ব্যোমকেশ চাবি বাহির করিয়া তাহার সম্মুখে ধরিল, ‘এ চাবিটা চিনতে পারেন?’
নৃপেনের চোখের চাহনি এতক্ষণ সহজ ও সিধা ছিল, মুহুর্তে তাহা চোরা চাহনিতে পরিণত হইল। একবার ঢোক গিলিয়া সে স্বর্যযন্ত্র সংযত করিয়া লইল, তারপর বলিল, ‘চাবি? কার চাবি আমি কি করে চিনিব? মাফ করবেন, প্রভাতবাবুর জ্বর’–কথা শেষ না করিয়াই সে প্ৰভাতের ঘরের দিকে চলিয়া গেল।
ক্ষণেক দাঁড়াইয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ আমার কানে কানে বলিল, ‘অজিত, তুমি দাঁড়াও, আমি এখনি আসছি।’ সে লঘুপদে অনাদি হালদারের ঘরের দিকে চলিয়া গেল।
একলা দাঁড়াইয়া আছি; ভাবিতেছি কেহ যদি আসিয়া পড়ে এবং ব্যোমকেশ সম্বন্ধে সওয়াল আরম্ভ করে, তখন কি বলিব! কিন্তু মিনিটখানেক পরে ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিল, বলিল, ‘চল, এবার যাওয়া যাক।’
নীচে দাওয়ায় বসিয়া ষষ্ঠীবাবু হুঁকা চুষিতেছিলেন, আমাদের পানে কট্মট করিয়া তাকাইলেন রাস্তায় আলো জ্বলিয়াছে। আমরা দ্রুত বাসার দিকে পা চালাইলাম। চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ। বলিল, ‘অনাদি হালদারের আলমারির চাবিই বটে এবং কে গলিতে ফেলেছিল, সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই।’
১২
হাপ্তাখানেক কাটিয়া গেল। কোনও দিক হইতে আর কোনও সাড়া শব্দ নাই নিমাই-নিতাইকে ব্যোমকেশ অবিলম্বে আসিয়া দেখা করিতে বলিয়াছিল, তাহারাও নিশ্চুপ। আবার যেন সব ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। ইস্টিশন হইতে ট্রেন ছাড়িয়া গেলে যেমন হয়, এ যেন অনেকটা সেইরকম অবস্থা।
তারপর ট্রেন আসিল। একটার পর একটা ট্রেন আসিতে লাগিল। শেষ পর্যন্ত এত ট্রেন আসিল যে নিশ্বাস ফেলিবার সময় রহিল না।