সকালবেলা ডাকে দু’টি চিঠি আসিল। একটি চিঠি সত্যবতীর। সে দীর্ঘকাল আমাদের না। দেখিয়া আমাদের বাঁচিয়া থাকা সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া উঠিয়াছে, অবিলম্বে দর্শন চায়। দ্বিতীয় চিঠিখানি খেজুরহাটের রমেশ মল্লিকের। তিনি লিখিয়াছেন—
ভাই ব্যোমকেশ, তুমি তাহলে আমাকে ভোলনি? তোমার চিঠি পেয়ে কী আনন্দ যে হল বলতে পারি না। সেই পুরনো ভুলে যাওয়া কলেজ-জীবনের কথা আবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
ভাই, আমি তোমার সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করতে যেতাম, কিন্তু কিছুদিন থেকে বাতে শয্যাশায়ী হয়ে আছি, নড়বার ক্ষমতা নেই। তোমার কীর্তিকলাপ বইয়ে পড়েছি, তুমি কলকাতায় থাকো তাও জানি। কিন্তু ঠিকানা জানা ছিল না বলে এতদিন যেতে পারিনি। এবার সেরে উঠেই যাব।
তুমি যার কথা জানতে চেয়েছ তার সম্বন্ধে অনেক কথাই জানি, দেখা হলে সব বলব। ভারি গুণী লোক। একবার জেল খেটেছে। ওর প্রধান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে, যে-কোনও তালার চাবি একবার দেখলে অবিকল নকল চাবি তৈরি করতে পারে। গুণধর ছেলে, খুড়ো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুড়োর সিন্দুকের চাবি তৈরি করেছিল, মাঝে মাঝে পোশ দশ টাকা সরাতো। খুড়ো তাড়িয়ে দেবার পর কলকাতায় গিয়ে চাকরি করত, সেখানেও ক্যাশ-বাক্সর চাবি তৈরি করেছিল। ধরা পড়ে জেলে গেল। সে আজ চার পাঁচ বছরের কথা। তুমি কোন সূত্রে তার সম্পর্কে এসেছ জানি না, কিন্তু সাবধানে থেকো।
তোমাকে দেখার জন্যে মন ছট্ফটু করছে। আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা নিও। ইতি-তোমার রমেশ।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘গুণী লোক তাতে সন্দেহ কি। এমন গুণী লোক পৃথিবীতে অল্পই আছে। যাহোক, ন্যাপার কার্য-পদ্ধতি এবার বেশ বোঝা যাচ্ছে। অনাদি হালদার আলমারির চাবি কোমরে রাখত, দেখার সুবিধে ছিল না। কোনও সময় ন্যাপী একবার চাবিটা দেখে ফেলেছিল, সে চাবি তৈরি করল। আলমারিতে মাল আছে সে জানত, সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর কালীপুজোর রাত্ৰে— বলিয়া ব্যোমকেশ থামিল।
‘কালীপুজোর রাত্রে কী?’
ব্যোমকেশ উত্তর দিবার পূবেই দ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখি, অপূর্ব দৃশ্য। উকিল কামিনীকান্ত মুস্তকী দুই পাশে দুই মক্কেল লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কামিনীকান্তর মুখে সুধাবিগলিত হাসি। নিমাই ও নিতাইকে দেখিয়া মানুষ বলিয়া চেনা যায় না, সত্য সত্যই দু’টি ভিজা বিড়াল। খালি পা, গায়ে গরদের দোছোট, মুখে অক্ষৌরিত দাড়ি, অশৌচের বেশ।
তিনজনে ঘরে প্রবেশ করিলেন। ব্যোমকেশ আরাম-কেদারা হইতে একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, তাহার মুখের তাচ্ছিল্য-ভাব ক্ৰমে ব্যঙ্গহাস্যে পরিণত হইল। সে বলিল, ‘আপনারা শেষ পর্যন্ত এলেন তাহলে?—বসুন।’
তিনজনে তক্তপোশের কিনারায় বসিলেন। কামিনীকান্ত বলিলেন, ‘একটু দেরি হয়ে গেল। আপনি চিঠিতে যে-রকম ভয় দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ওরা একলা আসতে সাহস করেনি, আমার কাছে ছুটে গিয়েছিল। তা আমি হলাম গিয়ে উকিল, একটু খোঁজ-খবর না নিয়ে তো আসতে পারি না। তাই—‘
‘কোথায় খোঁজ-খবর নিলেন? শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাসে? সেখানে বুঝি সুবিধে হল না? সাক্ষী ভাঙাতে পারলেন না? শ্ৰীকান্তবাবু সত্যের অপলাপ করতে রাজী হলেন না?’
কামিনীকান্তবাবু আহত স্বরে বলিলেন, ‘ছি ছি, এ আপনি কি বলছেন, ব্যোমকেশবাবু! সাক্ষী ভাঙানো আমার পেশা নয়, মক্কেলের পক্ষ থেকে সত্য আবিষ্কার করাই আমার কাজ।’
‘সত্য আবিষ্কার করবার জন্যে শ্রীকান্ত হোটেলে যাবার দরকার ছিল না, মক্কেল দুটিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারতেন।’
‘ওরা ছেলেমানুষ, তার ওপর অশৌচ চলছে। যাহোক, আপনি কি জানতে চান বলুন, কোনও কথাই ওরা আপনার কাছে লুকোবে না। ওদের বয়ান শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, ওরা সম্পূর্ণনিদেৰ্য।’
ব্যোমকেশ নিতাই ও নিমাইকে পযায়িক্রমে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘এদের মধ্যে শ্ৰীকান্ত হোটেলে যাতায়াত করতেন কে?’
কামিনীকান্ত বলিলেন, ‘ওরা দু’জনেই যেত। তবে ওদের চেহারা অনেকটা একরকম, তাই বোধহয় হোটেলের লোকেরা বুঝতে পারেনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। শ্ৰীকান্ত হোটেলের তেতলার ঘর ভাড়া নেবার উদ্দেশ্য কি?’
কামিনীকান্ত বলিলেন, ‘তাহলে গোড়া থেকেই সব খুলে বলি–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওঁদের কথা ওঁরা নিজের মুখে বললেই ভাল হত না?’
‘হেঁ হেঁ, সে তো ঠিক কথা। তবে কি জানেন, ওরা ছেলেমানুষ, তার ওপর ব্যাপারস্যাপার দেখে খুবই নাভাস হয়ে পড়েছে। হয়তো বলতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলবে-আপনি সন্দেহ করবেন ওরা মিছে কথা বলছে—’
নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ আপনিই বলুন তাহলে। বুঝতে পারছি আপনার বলা আর ওদের বলায় কোনও তফাৎ হবে না। মিছে সময় নষ্ট করে লাভ কি?’
ছেলেমানুষ দু’টি বাঙ্নিষ্পত্তি করিল না, কামিনীকান্ত তাদের জবানীতে কাহিনী বিবৃত করিলেন। মোটামুটি কাহিনীটি এই—
বছর দুই আগে অনাদি হালদার মহাশয় যখন কলিকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন তখন নিমাই নিতাই খবর পাইয়া কাকার কাছে ছুটিয়া আসে। তাহারা পিতৃহীন, কাকাই তাঁহাদের একমাত্র অভিভাবক, কাকাকে তাহারা সাবেক বাড়িতে লইয়া যাইবার জন্য নির্বন্ধ করে।
অনাদি হালদার অতিশয় সজ্জন এবং ভালো মানুষ ছিলেন, ভাইপোদের প্রতি তাঁহার মেহের সীমা ছিল না। কিন্তু একদল দুষ্ট লোক তাঁহার ভালমানুষীর সুযোগ লইয়া ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছিল, তাঁহার কানে কুমন্ত্রণা দিতে লাগিল, ভাইপোদের উপর তাঁহার মন বিরূপ করিয়া তুলিল। তিনি নিতাই-নিমাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া দিলেন।