আদিম রিপু

নিমাই নিতাই ন্যায়তঃ ধৰ্মতঃ অনাদিবাবুর উত্তরাধিকারী। তাঁহাদের ভয় হইল‌, এই দুষ্ট লোকগুলো কাকাকে ঠকাইয়া সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবে‌, হয়তো তাঁহাকে খুন করিতেও পারে। নিমাই নিতাই তখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া শ্ৰীকান্ত হোটেলে ঘর ভাড়া করিল। এবং জানোলা দিয়া অনাদিবাবুর বাসার উপর নজর রাখিতে লাগিল। তাঁহাদের বাড়িতে একটাশ পুরনো আমলের দূরবীন আছে‌, সেই দূরবীন চোখে লাগাইয়া অনাদিবাবুর বাসার ভিতরকার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করিবার চেষ্টা করিত। এই দেখুন সেই দূরবীন।

—নিমাইনিতাইয়ের একজন চাদরের ভিতর হইতে দূরবীন বাহির করিয়া দেখাইল। চামড়ার খাপের মধ্যে চোঙের মত দূরবীন‌, টানিলে লম্বা হয়; ব্যোমকেশ নাড়িয়া চাড়িয়া ফেরত দিল। কামিনীকান্ত আবার আরম্ভ করিলেন। —

নিমাই নিতাই পালা করিয়া হোটেলে যাইত এবং চোখে দূরবীন লাগাইয়া জানালার কাছে বসিয়া থাকিত। অবশ্য ইহা নিতান্তাই ছেলেমানুষী কাণ্ড। কামিনীকান্ত কিছু জানিতেন না‌, জানিলে এমন হাস্যকর ব্যাপার ঘটিতে দিতেন না। যাহোক‌, এইভাবে কয়েকমাস কাটিবার পর কালীপূজার রাত্ৰি আসিয়া উপস্থিত হইল।

রাত্রি দশটা আন্দাজ নিমাই হোটেলে গিয়া দূরবীন লাগাইয়া বসিল। অনাদিবাবু ব্যালকনিতে দাঁড়াইয়া বাজি পোড়ানো দেখিতেছিলেন। এগারোটার সময় এক ব্যাপার ঘটিল। অনাদিবাবু হঠাৎ পিছনের দরজার দিকে ফিরিলেন‌, যেন পিছনে কাহারও সাড়া পাইয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের আওয়াজ হইল এবং বন্দুকের গুলি নিমাইয়ের কানের পাশ দিয়া চলিয়া গেল। ওদিকে ব্যালকনিতে অনাদিবাবু ধরাশায়ী হইলেন। কিন্তু ঘরের অন্ধকার হইতে কে গুলি চালাইয়াছে নিমাই তাহা দেখিতে পাইল না।

নিমাই ব্যাপার বুঝিতে পারিল। বন্দুকের গুলি অনাদিবাবুর শরীর ভেদ করিয়া আর একটু হইলে নিমাইকেও বধ করিত; ভাগ্যক্রমে গুলিটা তাহার রগ ঘোষিয়া চলিয়া গিয়াছে। সে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরিয়া গেল এবং দুই ভাইয়ে পরামর্শ করিয়া সেই রাত্রেই কামিনীকান্তর কাছে উপস্থিত হইল। তারপর যাহা যাহা ঘটিয়াছে ব্যোমকেশবাবু তাহা ভালভাবেই জানেন।

ইহাই সত্য পরিস্থিতি‌, ইহাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নাই। ব্যোমকেশবাবু বিবেচক ব্যক্তি‌, তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছেন যে পূজ্যপাদ খুল্লতাতকে বধ করা কোনও ভদ্রলোকের ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব তিনি যেন পুলিসে খবর না দেন। পুলিস-বিশেষত বর্তমানকালের পুলিস-যদি এমন একটা ছুতা পায় তাহা হইলে নিতাই-নিমাইকে নাস্তানাবুদ করিয়া ছাড়িবে‌, নিরাপরাধের প্রতি জুলুম করিবে। ইহা কদাচ বাঞ্ছনীয় নয়। একেই তো অবিচার অত্যাচারে দেশ ছাইয়া গিয়াছে।

কামিনীকান্ত শেষ করিলে ব্যোমকেশ আড়মোড়া ভাঙিয়া হাই তুলিল‌, অলসকণ্ঠে বলিল‌, ‘এঁরা succession certificate-এর জন্য দরখাস্ত করেছেন নিশ্চয়? তার কি হল?’

কামিনীকান্ত বলিলেন‌, ‘দরখাস্ত করা হয়েছে। তবে আদালতের ব্যাপার‌, সময় লাগবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার বিশ্বাস প্রভাত কোনও আপত্তি তুলবে না। তবে বইয়ের দোকানটা তার নিজের নামে; আপনারা যদি সেদিকে হাত বাড়ন তাহলে সে লড়বে।’

‘না না‌, অনাদিবাবু যা দান করে গেছেন তার ওপর ওদের লোভ নেই। —তাহলে ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি শ্ৰীকান্ত হোটেলের কথাটা প্ৰকাশ করবেন না। আশা করতে পারি কি?’

‘এ বিষয়ে আমি বিবেচনা করে দেখব। নিমাইবাবু নিতাইবাবু যদি নির্দোষ হন তাহলে নিৰ্ভয়ে থাকতে পারেন। আচ্ছা‌, আজ আসুন তাহলে।’

তিনজনে গাত্ৰোত্থান করিয়া পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলেন‌, চোখে চোখে কথা হইল। তারপর কামিনীকান্ত একটু আমতা আমতা করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ আমরা আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ক্ষতিপূরণস্বরূপ সামান্য কিছু— বলিয়া পকেট হইতে পাঁচটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া বাড়াইয়া ধরিলেন।

ব্যোমকেশের অধর ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হইয়া উঠিল—’আমার সময়ের দাম অত বেশি নয়। তাছাড়া‌, আমি ঘুষ নিই না।’

কামিনীকান্ত তাড়াতাড়ি বলিলেন‌, ‘না না‌, সে কি কথা। আপনি অনাদিবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে তদন্তু করছেন‌, তার তো একটা খরচ আছে। সে খরচ এদেরই দেবার কথা। আচ্ছা‌, আর আপনার সময় নষ্ট করব না। নমস্কার।’ নোটগুলি টেবিলে রাখিয়া তিনি মক্কেল সহ ক্ষিপ্ৰবেগে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

ব্যোমকেশ নোটগুলি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল‌, ‘ঘুষ কি করে দিতে হয় শিখলাম।’ তারপর ভ্রূ বাঁকাইয়া আমার পানে চাহিল—’কেমন গল্প শুনলে?’

বলিলাম‌, ‘আমার তো নেহাৎ অসম্ভব মনে হল না।’

‘এরকম গল্প তুমি লিখতে পারো? সাহস আছে?’

‘এমন অনেক সত্য ঘটনা আছে যা গল্পের আকারে লেখা যায় না‌, লিখলে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তবু যা সত্য তা সত্যই। Truth is stranger than fiction.’

তর্ক বেশ জমিয়া উঠিবার উপক্ৰম করিতেছে এমন সময় দ্বারে আবার অতিথি সমাগম হইল। দরজা ভেজানো ছিল; একজন দরজার ফাঁকে মুণ্ড প্রবিষ্ট করাইয়া বলিল, ‘আসতে পারি স্যার?’ বলিয়া দাঁত খিঁচাইয়া হাসিল।

অবাক হইয়া দেখিলাম‌, বিকাশ দত্ত! বছরখানেক আগে চিড়িয়াখানা প্রসঙ্গে তাহার সহিত পরিচয় ঘটিয়াছিল। তাহার হাসিটি অটুট আছে। কিন্তু বেশভূষা দেখিয়া মনে হয় ধন-ভাগ্যে ভাঙন ধরিয়াছে।

ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া বিকাশকে বসাইল‌, হাসিয়া বলিল‌, ‘তারপর‌, খবর কি?’

বিকাশ বলিল‌, ‘খবর ভাল নয়। স্যার। চাকরি গেছে‌, এখন ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছি।’

ব্যোমকেশের মুখ গভীর হইল–’চাকরি গেল কোন অপরাধে?’

বিকাশ বলিল‌, ‘অপরাধ করলে তো ফাঁসি যেতম স্যার। অপরাধ করিনি। তাই চাকরি গেছে।’

0 Shares