‘হুঁ। তা এখন কি করছেন?’
‘কাজের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনার হাতে যদি কিছু থাকে তাই খবর নিতে এলাম।’
ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল, ‘কাজ-? আচ্ছা, কাজের কথা পরে হবে, আজ বেলা হয়ে গেছে, এখানেই খাওয়া-দাওয়া করুন।’
বিকাশের মুখে কৃতজ্ঞতার একটি ক্লিষ্ট হাসি ফুটিয়া উঠিল—’না স্যার, আমাকে দুপুরবেলা বাসায় ফিরতে হবে। যদি কিছু কাজ থাকে, ওবেলা আবার আসব।’
বিকাশের মুখ দেখিয়া মনে হইল তাহার বাসায় কোনও অভুক্ত প্রিয়জন তাহার পথ চাহিয়া আছে।
ব্যোমকেশ আবার একটু ভাবিয়া বলিল, ‘আমার হাতে একটা কাজ আছে সে কাজে আপনার মতন কুঁশিয়ার লোক চাই। একটি লোকের হাঁড়ির খবর যোগাড় করতে হবে?
বিকাশ পকেট হইতে ডায়েরির মত একটা খাতা ও পেন্সিল বাহির করিল—‘নাম?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শিউলী মজুমদারের নাম শুনেছেন?’
‘শিউলী মজুমদার? গান গায়?’
‘হ্যাঁ। তার বাপের নাম দয়ালহরি মজুমদার, ঠিকানা ১৩/৩, রামতনু লেন, শ্যামবাজার। এদের বাড়ির সব খবর সংগ্ৰহ করতে হবে।’
লিখিয়া লইয়া বিকাশ বলিল, ‘কবে খবর চান?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একদিনের কাজ নয়। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে খবর যোগাড় করতে হবে। অতীতের খবর, বর্তমানের খবর, বাড়িতে কারা আসে যায়, কী কথা বলে সব খবর চাই। অনাদি হালদার আর প্রভাত-এই দুটো নাম মনে রাখবেন। যখনই কিছু খবর পাবেন আমাকে এসে জানাবেন।’
‘বেশ, আজ তাহলে উঠি।’ খাতা পেন্সিল পকেটে পুরিয়া বিকাশ উঠিয়া দাঁড়াইল।
ব্যোমকেশ একটি একশত টাকার নোট তাহার হাতে দিয়া বলিল, ‘আজ একশো টাকা রাখুন। কাজ হয়ে গেলে আরও পাবেন।’
নোট হাতে লইয়া বিকাশ কিছুক্ষণ অপলক চক্ষে সেইদিকে চাহিয়া রহিল, তারপর চোখ তুলিয়া বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, পেটে ভাত না থাকলে মুখ দেখে ধরা যায়-না? আপনি ঠিক ধরেছেন?’ খপ করিয়া ব্যোমকেশের পায়ের ধূলা লইয়া বিকাশ দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।
ব্যোমকেশ দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া খামখেয়ালী গোছের হাসিল–’কিছু টাকার সদগতি হল। চল, আর দেরি নয়, নেয়ে খেয়ে নেওয়া যাক। নৈলে এখনি হয়তো আবার নতুন অতিথি এসে হাজির হবে।’
১৩
অপরাহ্নে পুঁটিরাম যখন চা লইয়া আসিল তখন লক্ষ্য করিলাম, তাহার মুখখানা শীর্ণ ও কেন্দনাক্লিষ্ট। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি রে, কি হয়েছে?’
পুঁটিরাম বলিল, ‘আবার অম্বলের ব্যথা ধরেছে বাবু।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি ওষুধ দিচ্ছি, তুই শুয়ে থাকগে যা। এ বেলা আর তোকে রাঁধতে হবে না।’
কিছুদিন হইতে পুঁটিরামকে অম্লশূলে ধরিয়াছে; বিশুদ্ধ কাঁকর এবং তেঁতুল বিচির গুড়া তাহার সহ্য হইতেছে না। ব্যোমকেশ তাহাকে যোয়ানের জল দিয়া ফিরিয়া আসিলে বলিলাম, নীচে খবর পাঠাই, মেসেই আজ আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হোক।’
ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল, ‘না, চল আজ কোনও হোটেলে খেয়ে আসি। আজ পাঁচশো টাকা হাতে এসেছে, বর্বরস্য ধনক্ষয়ং হওয়া দরকার।’
আমি তাহার এই লঘুতায় সায় দিতে পারিলাম না, বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কিছু মনে করো না। ওই পাঁচশো টাকা যে ঘুষ যখন বুঝতে পেরেছ তখন ও টাকা নেওয়া কি তোমার উচিত হয়েছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে পারি। কিন্তু তা করব না। টাকা আমার চাই তাই নিয়েছি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পারব না।’
‘কিন্তু ধরো-যদি শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে, নিমাই নিতাই খুন করেছে, তখন কি করবে? ঘুষ খেয়ে কথাটা চেপে যাবে?’
‘না, চেপে যাব না, ওদেরই ধরিয়ে দেব। অবশ্য যদি পুলিস ধরতে চায়। মনে রেখো, অনাদি হালদারের খুনের তদন্তু করবার জন্যই ওরা আমাকে টাকা দিয়েছে, ঘুষ বলে দেয়নি।’
‘তা যদি হয় তাহলে স্বতন্ত্র কথা।’
‘তোমার ভয় নেই, ঘুষ খেয়ে আমি অধৰ্ম করব না। অধৰ্ম করার মতলব যদি থাকত তাহলে পাঁচশো টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট হতাম না, রীতিমত আখেরের রেস্ত করে নিতাম।’ বলিয়া ব্যোমকেশ হাসিল।
চা শেষ করিয়া সিগারেট ধরাইলাম। এ বেলা বোধহয় আর অতিথি অভ্যাগতের শুভাগমন হইবে না ভাবিতেছি, প্রভাত আসিয়া উপস্থিত। তাহার হাতে একটি বৌচুকা, চেহারা দেখিয়া বোঝা যায়, সম্প্রতি রোগ হইতে উঠিয়াছে, চোখের মধ্যে দুর্বলতার চিহ্ন এখনও লুপ্ত হয় নাই। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন। এখন শরীর কেমন?’
লজিত হাসিয়া প্ৰভাত বলিল, ‘সেরে গেছে। সেদিন অনেক কষ্ট দিলাম। আপনাদের।’
‘কিছু না। হাতে ওটা কি?’
‘একটু মিষ্টি। ভীম নাগের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম কিছু নিয়ে যাই।’
বোঁচ্কা খুলিলে দেখা গেল, মিষ্টি অল্প নয়, প্রায় কুড়ি পঁচিশ টাকার কড়া পাকের সন্দেশ। সেদিন ব্যোমকেশ তাহার উপকার করিয়াছিল, ডাক্তার গাড়ি-ভাড়া প্রভৃতির খরচ লয় নাই, তাই প্রভাত অত্যন্ত শিষ্টভাবে তাহা প্রত্যাৰ্পণ করিতে চায়। ব্যোমকেশ উল্লসিত হইয়া বলিল, ‘আরে আরে, এ যে স্বর্গীয় ব্যাপার। অজিত, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম বল তো?’
বলিলাম, যতদূর মনে পড়ে তুমি আমার মুখ দেখেছিলে এবং আমি তোমার মুখ দেখেছিলাম।’
‘তবেই বোঝে, আমাদের মুখ দুটো সামান্য নয়। যাহোক, খাবারগুলো সরিয়ে রাখা ভাল, বাইরে ফেলে রাখা কিছু নয়।’ ব্যোমকেশ সন্দেশগুলি ভিতরে রাখিয়া আসিয়া বলিল, ‘প্রভাতবাবু্, চা খাবেন নাকি?’
‘আজ্ঞে না, আমি চ খেয়ে এসেছি।’ সে ঘরের এদিক ওদিক চাহিয়া বলিল, ‘এখানে কেবল আপনারা দু’জনে থাকেন বুঝি?’।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘উপস্থিত দু’জনেই আছি। আমার স্ত্রী এবং ছেলে এখন পাটনায়।’