প্রভাতের চোখ দুইটি যেন নৃত্য করিয়া উঠিল—’পাটনায়!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, যা হাঙ্গামা চলেছে, তাদের বাইরে রেখেছি। আপনি বুঝি পাটনা এখনও ভুলতে পারেননি।’
‘পাটনা ভুলব!’ প্ৰভাতের স্বর গাঢ় হইয়া উঠিল—’জন্মে অব্দি পাটনাতেই কাটিয়েছি। কত বন্ধু আছে সেখানে। ইশাক সাহেব আছেন।’
‘ইশাক সাহেব?’
‘আমার ওস্তাদ। তাঁর দোকানে চাকরি করতাম, তিনি হাতে ধরে আমাকে দপ্তরীর কাজ শিখিয়েছিলেন। এমন ভাল লোক হয় না, দেবতুল্য লোক। এখন বুড়ো হয়েছেন.কে তাঁর দোকানে কাজ করছে কে জানে…হয়তো তিনি একই কাজ করেছেন।’ প্ৰভাত নিশ্বাস ফেলিল।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘পাটনায় কোন পাড়ায় থাকেন তিনি?’
‘সিটিতে থাকেন। সেখানে সকলেই তাঁকে চেনে। আমার আর ওদিকে যাওয়া হয়নি, সেই যে পাটনা থেকে এসেছি, আর যাইনি। ব্যোমকেশবাবু্, আপনি নিশ্চয় মাঝে মাঝে পাটনা যান? এবার যখন যাবেন ইশাক সাহেবকে দেখে আসবেন? কেমন আছেন তিনি-বড় দেখতে ইচ্ছে করে।’
‘নিশ্চয় দেখা করব। তারপর এদিকের খবর কি? কেষ্টবাবু কেমন আছেন?’
প্রভাত বলিল, ‘কেষ্টবাবু চলে গেছেন।’
চলে গেছেন?’
‘হ্যাঁ। আমার বাসায় ওঁর পোষাল না। মা’র সঙ্গে দিনরাত খিটিমিটি লাগত। তারপর একদিন নিজেই চলে গেলেন।’
‘যাক, আপনার ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামল। আর নৃপেনবাবু? তিনি কি আপনার দোকানে কাজ করছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি কাজ করেন?’
‘বইয়ের দেকানে অনেক ছুটোছুটির কাজ আছে। অন্য দোকান থেকে বই আনতে হয়, ভি পি পাঠাবার জন্যে পোস্ট অফিসে যেতে হয়। এসব কাজ আগে আমাকেই করতে হত। এখন নৃপেনবাবু করেন।’
‘ভাল।’
প্রভাত এতক্ষণ বোমকেশের সঙ্গে কথা বলিতেছিল, মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাইতেছিল; এখন সে আমার দিকে ফিরিয়া বসিয়া বলিল, ‘অজিতবাবু্, আমি আপনার কাছে আসব বলেছিলাম মনে আছে বোধহয়। এইসব গণ্ডগোলে আসতে পারিনি। আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে।’
‘কি অনুরোধ বলুন।’
‘আপনার একখানি উপন্যাস আমাকে দিতে হবে। আমি গরীব প্রকাশক, নতুন দোকান করেছি। তবু অন্য প্রকাশকের কাছ থেকে আপনি যা পান আমিও তাই দেব।’
নূতন প্রকাশককে বই দেওয়ায় বিপদ আছে, কখন লালবাতি জ্বালিবে বলা যায় না। একবার এক অবচিীনকে বই দিয়া ঠকিয়াছি। আমি ইতস্তত করিয়া বলিলাম, ‘তা, এখন তো আমার হাতে কিছু নেই-’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কেন, যে উপন্যাসটা ধরেছ সেটা দিতে পারো। প্রভাতবাবু্, আপনি ভাববেন না, অজিতের বই আপনি পাবেন।’
প্রভাত উৎসাহিত হইয়া বলিল, ‘যখন আপনার বই শেষ হবে তখন দেবেন। এখন আমার দোকান ভাল চলছে না, পরের বই কমিশনে বিক্রি করে কতটুকুই বা লাভ থাকে। আপনাদের আশীবাদ পেলে আমি দোকান বড় করে তুলব।; প্ৰাণপণে খাটব, কিছুঁতেই নষ্ট হতে দেব না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই তো চাই। আপনাদের বয়সে কাজে উৎসাহ থাকা চাই। তবে উন্নতি করতে পারবেন।’
প্রভাত গদগদ মুখে পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিয়া তাহা হইতে দুইটি নোট লইয়া আমার সম্মুখে রাখিল। দেখিলাম দুইশত টাকা। সত্যই আজ কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম!
প্ৰভাত বলিল, ‘অগ্রিম প্ৰণামী দিলাম। বই লেখা শেষ হলেই বাকি টাকা দিয়ে যাব।’ সে উঠিয়া দাঁড়াইল।
বলিলাম, ‘রসিদ নিয়ে যান।’
সে বলিল, ‘না, না, এখন রসিদ থাক, সব টাকা দিয়ে রসিদ নেব। আজ যাই, সন্ধ্যে হয়ে গেল, এখনও দোকান খোলা হয়নি।’
প্রভাত প্ৰস্থান করিলে আমরা কিছুক্ষণ বিস্ময়-পুলকিত নেত্রে পরস্পর চাহিয়া রহিলাম। তারপর নোট দু’টি সস্নেহে পকেটে রাখিয়া বলিলাম, ‘কাণ্ডখোনা কি! এ যে শ্রাবণের ধারার মত ক্ৰমাগত একশো টাকার নোট বৃষ্টি হচ্ছে!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। এত সুখ সইলে হয়।’
এই সময় দ্বারদেশে বাঁটুলের আবির্ভাব হইল। তাহার আবার চাঁদা আদায়ের সময় হইয়াছে। সে ভক্তিভারে আমাদের প্রণাম করিয়া বিলল, ‘চাঁদটিা নিতে এলাম কর্তা।’
ব্যোমকেশ আমার দিকে চাহিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার হাসির অর্থ; জীবন-ব্যবসায়ে শুধু আমদানি নয়, রপ্তানিও আছে।
বাঁটুলকে বসাইয়া ব্যোমকেশ টাকা আনিতে গেল। কামিনীকান্তর দেওয়া নোটগুলি হইতে একটি আনিয়া বাঁটুলকে দিল–’ভাঙনি আছে বাঁটুল?’
‘আজ্ঞে, আছে।’
বাঁটুল কোমর হইতে গেজে বাহির করিল। বেশ পরিপুষ্ট গেজে; তাহাতে খুচরা রেজাগি হইতে নানা অঙ্কের নোট পর্যন্ত রহিয়াছে। কয়েকটি একশত টাকার নোটও চোখে পড়িল। বাঁটুল হিসাব করিয়া ভাঙনি ফেরত দিল, তারপর গেজে। আবার কোমরে বাঁধিল। বাঁটুলের ব্যবসা যে লাভের ব্যবসা তাহাতে সন্দেহ নাই।
ব্যোমকেশ বাঁটুলকে সিগারেট দিল—’বাঁটুল, অনাদি হালদার মারা গেছে শুনেছ বোধহয়?’
বাঁটুল চোখ তুলিল না, সযত্নে সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল, ‘আজ্ঞে, শুনেছি।’
‘কেউ তাকে গুলি করে মেরেছে।’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ। তাই তো গুজব।’
‘তুমি তো অনেক খবর-টাবর রাখো, কে মেরেছে আন্দাজ করতে পারো না?’
‘কলকাতায় লাখ লাখ লোক আছে, কত, তার মধ্যে কে মেরেছে কি করে আন্দাজ করব। তবে এ কথাও বলতে হয়, উনি চুলকে ঘা করলেন। আমার চাঁদা বন্ধ না করলে বেঘোরে প্রাণটা যেত না। আমি রক্ষে করতাম।’
‘বটেই তো! জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা কি উচিত! অনাদি হালদারের দুবুদ্ধি হয়েছিল। সে যাক। বাঁটুল, তোমরা রাইফেল ভাড়া দাও?’
‘আজ্ঞে, দিই।’
‘কি রকম শর্তে ভাড়া দাও?’
‘আজ্ঞে, ভাড়া একদিনের জন্যে কুল্লে পাঁচিশ টাকা; রাইফেল আর দু’টি টোটা পাবেন। তবে ভাড়া নেবার সময় তিনশো টাকা জমা দিতে হয়, রাইফেল ফেরত দিলে ভাড়া কেটে নিয়ে টাকা ফেরত দিই। আপনাদের চাই নাকি কর্তা?’