আদিম রিপু

‘না‌, উপস্থিত দরকার নেই‌, দরটা জেনে রাখলাম। আচ্ছা বাঁটুল‌, যে-রাত্রে অনাদি হালদার খুন হয় সে-রাত্রে কাউকে রাইফেল ভাড়া দিয়েছিলে?’

বাঁটুল উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘আজ্ঞে কতা‌, সে কথা বলতে পারব না। একজন খদ্দেরের কথা আর একজনকে বললে বেইমানী হয়‌, আমাদের ব্যবসা চলে না। আচ্ছা‌, আজ আসি। পোন্নাম হই।’

বাঁটুল চলিয়া গেল‌, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় লম্বা হইয়া বোধকরি ঝিমাইয়া পড়িল। আমার মনটা এদিক ওদিক ঘুরিয়া দুইশত টাকার কাছে ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতে লাগিল। টাকা যখন লইয়াছি তখন উপন্যাসটা তাড়াতাড়ি শেষ করিতে হইবে। অথচ তাড়াহুড়া করিয়া আমার লেখা হয় না; মনটা যখন নিশ্চিন্তু নিস্তরঙ্গ হয় তখনই কলম চলে। উপন্যাসের কথাই ভাবিতে লাগিলাম; তাহার মধ্যে নিমাই নিতাই প্রভাত বাঁটুল সকলেই মাঝে মাঝে উকিঝুকি মারিতে লাগিল।

ঘণ্টা দুই পরে পেটে ক্ষুধার উদয় হইলে বলিলাম‌, ‘চল‌, এবার বেরুনো যাক। হোটেলের খরচ আজ না হয়। আমিই দেব।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সাধু সাধু।’

আমাদের বাসার অনতিদূরে একটি হোটেল আছে। দোতলার উপর হোটেল‌, সরু সিঁড়ি দিয়া উঠিতে হয়; সিঁড়ির মাথায় স্থূলকায় ম্যানেজার টেবিলের উপর ক্যাশ-বাক্স লইয়া বসিয়া থাকেন। আশেপাশে ছোট ছোট কুঠুরিতে টেবিল পাতা। বিশেষ জাঁকজমক নাই‌, কিন্তু রান্না ভাল।

হোটেলে উপস্থিত হইলে ম্যানেজার বলিলেন‌, ‘পাঁচ নম্বর।’ অমনি একজন ভৃত্য আসিয়া আমাদের পাঁচ নম্বর কুঠুরির দিকে লইয়া চলিল। একটি গলির দুই পাশে সারি সারি কুঠুরি; যাইতে যাইতে একটি কুঠুরির সম্মুখে গিয়া পা আপনি থামিয়া গেল। আমি ব্যোমকেশের গা টিপিলাম। পদার ফাঁক দিয়া দেখা যাইতেছে‌, কেষ্টবাবু একাকী বসিয়া আহার করিতেছেন। তাঁহার গায়ে সিঙ্কের পাঞ্জাবির উপর পাট করা শাল‌, মুখে ধনগর্বের গান্তীর্য। তাঁহার সামনে শ্বেতবস্ত্রাবৃত টেবিলের উপর অনেকগুলি প্লেটে রাজসিক খাদ্যদ্রব্য সাজানো; একটি প্লেটে আস্ত রোস্ট মুরগি উত্তানপাদ অবস্থায় বিরাজ করিতেছে। পাশে একটি বোতল।

কেষ্টবাবু পানাহারে মগ্ন‌, দরজার বাহিরে আমাদের লক্ষ্য করিলেন না। আমরা পাশের প্রকোষ্ঠে গিয়া বসিলাম।

ভৃত্যকে অডার দিলে সে খাবার লইয়া আসিল; আমরা খাইতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশের প্রাক্তন প্ৰসন্নতা আর নাই‌, সে যেন ভাল ভাল খাদ্যগুলি উপভোগ করিতেছে না।

আধা ঘণ্টা পরে ভোজন শেষ করিয়া কোটির হইতে নিৰ্গত হইলাম! ম্যানেজারের টেবিলের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কেষ্টবাবু হোটেলের ঋণ শোধ করিতেছেন। রাজকীয় ভঙ্গীতে পকেট হইতে একশত টাকার নোট লইয়া টেবিলের উপর ফেলিয়া দিলেন।

এই লইয়া আজ চারবার একশত টাকার নোট দেখিলাম। দেশটা সম্ভবত রাতারাতি বড়মানুষ হইয়া উঠিয়াছে‌, ইংরেজ বিদায় লইবার পূর্বেই আমাদের কপাল ফিরিয়াছে। স্বাধীনতা লাভের আর দেরি নাই।

ম্যানেজার ভাঙনি ফেরত দিলেন‌, কেষ্টবাবু তাহা অবজ্ঞাভরে পকেটে ফেলিয়া পিছন ফিরিলেন। আমরা পিছনেই ছিলাম।

চোখাচোখি হইল। কেষ্টবাবুর চোয়াল বুলিয়া পড়িল। তারপর তিনি পাকশািট খাইয়া ঝটিতি সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন।

আমরা যখন হোটেলের প্রাপ্য চুকাইয়া পথে নামিলাম কেষ্টবাবু তখন অদৃশ্য হইয়াছেন।

বাসার দিকে চলিতে চলিতে বলিলাম‌, আজকের দিনটা ঘটনাবহুল বলা চলে‌, এমন কি টাকাবহুল বললেও অত্যুক্তি হয় না। এ যেন চারিদিকে একশো টাকার নোটের হরির লুট হচ্ছে।’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না।

আরও খানিক দূর চলিবার পর বলিলাম‌, ‘কী ভাবছ এত?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল অজিত‌, পাটনা যাই। সকালে একটা ট্রেন আছে।’

আমি ফুটপাথের মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িলাম–’পাটনা যাবে! আর এদিকে?’

‘এদিকে আর কিছু করবার নেই।’

‘তার মানে অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে তা বুঝতে পেরেছ।’

‘বোধহয় পেরেছি। কিন্তু তাকে ধরবার উপায় নেই।’

আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম—’কে খুন করেছে?’

ব্যোমকেশ আকাশের দিকে চোখ তুলিল; বুঝিলাম আবোল-তাবোল আবৃত্তি করিবার উদ্যোগ করিতেছে। বলিলাম‌, ‘বলতে না চাও বোলো না। কিন্তু বিকাশ দত্তকে খবর সংগ্ৰহ করবার জন্যে টাকা দিয়েছ তার কি হবে?’

‘বিকাশ ওস্তাদ ছেলে‌, জানাবার মত খবর থাকলে সে ঠিক আমাকে জানাবে।’

‘কিন্তু আসল খবর যখন জানতেই পেরেছ তখন আর খবরে দরকার কি?’

‘দরকার হয়তো নেই‌, কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়। সুন্দরী যুবতীরা প্রসাধন করেন কেন? বন্ধল পরে থাকলেই পারেন। থাকেন না। তার কারণ‌, অধিকন্তু ন দোষায়।’

‘তুমি কি সুন্দরী যুবতী?’

‘না‌, আমি সুন্দর যুবক। আমার জন্যে আমার বউয়ের মন কেমন করছে। সুতরাং আর দেরি নয়। কাল সকালেই-পাটনা।’

১৪

আমাদের পাটনা যাত্রার পর হইতে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত এই কয় মাস আমাদের জীবনের ধারাবাহিকতা অনেকটা নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। নানা বিচিত্ৰ ঘটনার মধ্যে পড়িয়া অনাদি হালদার ঘটিত ব্যাপারের খেই হারাইয়া গিয়াছিল। এই কাহিনীতে সে সকল অবাস্তর ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবৃতি অনাবশ্যক‌, কেবল সংক্ষেপে এই আট-নয় মাস কি করিয়া কাটিল তাহার আন্দাজ দিয়া নির্দিষ্ট বিষয়ে ফিরিয়া যাইব।

পাটনায় পৌঁছিয়া দশ-বারো দিন বেশ নিরুপদ্রবে। কাটিল; তারপর একদিন পুরন্দর পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। পাণ্ডেজি বছরখানেক হইল বদলি হইয়া পাটনায় আসিয়াছেন। সেই যে দুৰ্গরহস্য সম্পর্কে তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম‌, তারপর দেখা হয় নাই। পাণ্ডেজি খুশি হইলেন‌, আমরাও কম খুশি হইলাম না। পাণ্ডেজি মৃত্যু-রহস্যের অগ্রদূত। আমাদের সহিত দেখা হইবার দু। একদিন পরেই একটি রহস্যময় মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হইল এবং শেষ পর্যন্ত ব্যোমকেশকেই সে রহস্য ভেদ করিতে হইল। একদিন সে কাহিনী বলিবার ইচ্ছা রহিল।

0 Shares