আদিম রিপু

ব্যোমকেশ চলিয়া গেলে আমি একলা পড়িয়া গেলাম। দূরে রণবাদ্য শুনিয়া আস্তাবলে বাঁধা লড়য়ে-ঘোড়ার যে অবস্থা হয় আমার অবস্থাও কতকটা সেই রকম দাঁড়াইল। এইভাবে পাটনায় যখন আর মন টিকিল না। তখন কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।

কিন্তু কলিকাতার বাসা শূন্য। ভাবিয়াছিলাম‌, নিরিবিলিতে উপন্যাসে মন বসাইতে পারিব‌, কিন্তু মন বসিতে চাহিল না। প্ৰভাতের নিকট হইতে টাকা লইয়াছি‌, একটা কিছু করা দরকার‌, এই সঙ্কল্পটাই মনের মধ্যে পাক খাইতে লাগিল।

একদিন প্ৰভাতের দোকানে গেলাম। আমাকে দেখিয়া সে গলা উচু করিয়া বলিল‌, ‘পাটনা থেকে কবে ফিরলেন? আমি মাঝে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। ইশাক সাহেবের খবর নিয়েছিলেন?’

ইশাক সাহেবের খবর বলিলাম। প্ৰভাত কিছুক্ষণ অচল হইয়া বসিয়া রহিল‌, তারপর কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিতে লাগিল। আমি সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করিলাম না‌, আবার দেখা হইবে বলিয়া চলিয়া আসিলাম।

পরদিন প্ৰভাতের চিঠি লইয়া নৃপেন আসিল। চিঠিতে দু’ ছত্র লেখা—

মাননীয়েষু‌, কাল কোনও কথা হইল না‌, সেজন্য লজ্জিত। ব্যোমকেশবাবুকি ফিরিয়াছেন?

উপন্যাসের কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছি। আশা করি অগ্রসর হইতেছে। ইতি নিবেদক প্রভাত রায়।

নৃপেনকে বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ এখনও ফেরেনি।–আপনি এখনও প্রভাতবাবুর দোকানেই কাজ করছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আছেন কোথায়?’

‘পুরানো বাসাতেই আছি। প্রভাতবাবু থাকতে দিয়েছেন।’

‘ননীবালা দেবীর সঙ্গে বেশ বনিবনাও হচ্ছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন।’

‘ওদিকের খবর কি? নিমাই নিতাই?’

‘ওরা আদালতের হুকুম পেয়েছে। আমাদের বাসায় অনাদিবাবুর যেসব জিনিস ছিল সব তুলে নিয়ে গেছে। আলমারিও নিয়ে গেছে।’

‘পুলিসের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেয়েছেন?’

‘কিছু না।’

‘কেষ্টবাবুর খবর কি?’।

‘জানি না। সেই যে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারপর আর দেখিনি।’

নৃপেন চলিয়া গেল।

উপন্যাস লইয়া বসিলাম। কিন্তু মন বিক্ষিপ্ত্‌্‌, তাহাকে কলমের ডগায় ফিরাইয়া আনিতে পারিলাম না। আরও কয়েকদিন ছটফট করিয়া পাটনায় ফিরিয়া গেলাম।

ব্যোমকেশ দিল্লী হইতে ফিরে নাই। গোটা দুই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পোস্টকার্ড আসিয়াছে‌, ভাল আছি‌, ভাবনা করিও না। কবে ফিরিব স্থিরতা নাই।

এদিকে স্বাধীনতা দিবস অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সমস্ত দেশ অভাবনীয় সম্ভাবনার আশায় যেন দিশাহারা হইয়া গিয়াছে।

আগস্ট মাসের দশ তারিখে হঠাৎ ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিল।

রোগ হইয়া গিয়াছে‌, কিন্তু শুষ্ক মুখে বিজয়ীর হাসি। বলিল‌, ‘আর না‌, চল‌, কলকাতায় ফেরা যাক। পুঁটিরামকে একখানা পোস্টকার্ড লিখে দাও।’

১৫

ইচ্ছা ছিল সত্যবতী ও খোকাকে লইয়া একসঙ্গে কলিকাতায় ফিরিব‌, সত্যবতীও এতদিন বাহিরে বাহিরে থাকিয়া ঘরে ফিরিবার জন্য দড়িাছেড়া হইয়াছিল‌, কিন্তু তাহা সম্ভব হইল না। পাটনায় দীর্ঘকাল থাকার ফলে বেশ একটি সংসার গড়িয়া উঠিয়াছিল‌, তাহা গুটিাইয়া লইবার ভার এক সুকুমারের ঘাড়ে চাপাইয়া চলিয়া যাইতে পারিলাম না। কথা হইল হগুপ্তাখানেক পরে সুকুমার সুন্টু ইয়া ফিরিবে‌, আমরা আগে গিয়া বাসাটা সাজাইয়া গুছইয়া সত্যবতীর উপযোগী করিয়া রাখিব।

১৩ আগস্ট প্রত্যুষে আমি ও ব্যোমকেশ কলিকাতায় পৌঁছিলাম।

তখনও সুযোদয় হয় নাই। বাসার সম্মুখে ট্যাক্সি হইতে নামিয়া দেখি আমাদের সদর দরজার সামনে ভিড় জমিয়াছে। ভিড়ের মধ্যে পুঁটিরামকে দেখা গেল। ব্যাপার কি। আমরা ভিড় ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম। একটি মৃতদেহ ফুটপাথে পড়িয়া আছে‌, পিঠের বাঁ দিকে রক্তের দাগ শুকাইয়া জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে। দৃষ্টিহীন চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া খোলা।

চিনিতে কষ্ট হইল না‌, কেষ্টবাবু।

এখনও পুলিস আসিয়া পৌঁছে নাই। আমরা ভিড়ের বাহিরে আসিলাম‌, পুঁটিরামকে ডাকিয়া লইয়া উপরে চলিলাম। ব্যোমকেশের মুখ লোহার মত শক্ত হইয়া উঠিয়াছে‌, চোখে চাপা আগুন।

নিজেদের বসিবার ঘরে গিয়া দু’জনে উপবিষ্ট হইলাম। কেষ্টবাবুর হঠাৎ ভাগ্যোন্নতি যে এইরূপ পরিণতি লাভ করিবে তাহা কে ভাবিয়ছিল। আমি বলিলাম‌, ‘আমার ধারণা হয়েছিল কলকাতায় সম্মুখ-সমর বন্ধ হয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এটা সম্মুখ-সমর নয়‌, কেষ্ট দাসকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছে। পুঁটিরাম‌, তুই চিনতে পারলি?’

পুঁটিরাম বলিল‌, ‘আজ্ঞে চিনেছি‌, উনি সেই ভেটুকিমাছবাবু। কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছিলেন‌, আপনার কথা জিজ্ঞেস করলেন।’

‘কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছিল?’

‘আজ্ঞে। আমি বললাম‌, চিঠি পেয়েছি‌, বাবুরা কাল সকালে আসবেন। তখন তিনি চলে গেলেন। ‘

‘হুঁ। আচ্ছা পুঁটিরাম‌, তুই চা তৈরি কর গিয়ে।’

ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় পা ছড়াইয়া কড়িকাঠের দিকে ভ্রূকুটি করিয়া রহিল। আমি জানালায় গিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম ফুটপাথে পুলিসের আবির্ভাব হইয়াছে‌, ভিড় সরিয়া গিয়াছে। কেষ্টবাবুকে একটা মোটর ভ্যানে তুলিবার চেষ্টা হইতেছে। পুলিস কেষ্টরাবুর নাম ধাম জানিতে পারিল কিনা বোঝা গেল না। তাহারা লাশ লইয়া চলিয়া গেল।

চা আসিল। ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল‌, ‘লাশ দেখে মনে হয় শেষরাত্রির দিকে-রাত্রি তিনটে-চারটের সময়‌, কেষ্ট দাস খুন হয়েছে। প্রথম যেদিন কেষ্টবাবু আমার কাছে আসে সেও রাত্রি তিনটে-চারটের সময়। কিন্তু তখন একটা কারণ ছিল‌, আজ এতরাত্রে কি জন্যে আসছিল?’

বলিলাম‌, ‘তোমার কাছেই আসছিল তার প্রমাণ কি? মাতাল দাঁতাল মানুষ-হয়তো এই দিক দিয়ে যাচ্ছিল‌, গুণ্ডা ছুরি মেরেছে—’

0 Shares