না, এতবড় সমাপতন সম্ভব নয়, কেষ্ট দাস আমার কাছেই আসছিল। কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছিল, আমি নেই শুনে ফিরে গিয়েছিল। তারপর রাত্রে এমন কিছু ঘটল যে সে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না–ব্যোমকেশ হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘ভেবেছিলাম অনাদি হালদারের ব্যাপারটা ভুলে যাব, কিন্তু এরা ভুলতে দিলে না।’
‘অনাদি হালদারের সঙ্গে কেষ্টবাবুর মৃত্যুর সম্বন্ধ আছে নাকি?’
ব্যোমকেশ আমার প্রতি একটি কৃপাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, তারপর আরাম-কেদারায় লম্বা হইল।
বেলা আটটা নাগাদ বিকাশ দত্ত আসিল। তাহার আর সেই অন্তঃশূন্য চুপিসানো ভাব নাই; আমাদের দেখিয়া দাঁত খিঁচাইয়া বলিল, ‘এই যে আপনারা এসে গেছেন স্যার। আমি পাটনায় চিঠি লিখতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার দেখে যাই। কিছু নতুন খবর আছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বসুন, খবর শুনব। নিজের কথা আগে বলুন। আট-নয় মাস বাইরে ছিলাম, আপনার অসুবিধে হয়নি তো?’
বিকাশ বলিল, ‘অসুবিধে হয়েছিল স্যার। কিন্তু সে কিছু নয়। এখন সামলে নিয়েছি। তিন মাইল ঘাস কিনেছি, তাতেই চলে যাচ্ছে।’
‘তিন মাইল ঘাস!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।’
বিকাশ তিন মাইল ঘাসের রহস্য প্রকাশ করিল। রেল লাইনের দু’ধারে যে ঘাস জন্মায়, রেলের কর্তৃপক্ষ নাকি তাহা প্রতি বৎসর জমা দিয়া থাকেন। বিকাশ তিন মাইল ঘাস জমা লইয়াছে এবং গোয়ালাদের সেই ঘাস বিক্রয় করিতেছে। বিকাশের কোন কষ্ট নাই, গোয়ালারা অগ্রিম পয়সা দিয়া গরু মোষ চরায়; বিকাশের কিছু লাভ থাকে।
বিকাশ বলিল, ‘তাছাড়া চাকরিটা বোধহয় এবার ফিরে পাব স্যার।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ বেশ, এবার কি নতুন খবর আছে বলুন। আপনার ছাত্রকে আজ সকালে পড়াতে যাননি?’
বিকাশ বলিল, ‘পড়ােব কাকে স্যার? পাখি উড়েছে।’
‘সে কি?’
‘সেই খবরই তো দিতে এলাম। গোড়ার দিক থেকে বলব, না শেষের দিক থেকে?’
‘গোড়ার দিক থেকে বলুন।’
আপনাকে যে সব খবর দিয়েছিলাম তারপর আর নতুন খবর কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। টিমে-তে তালায় চলছিল, তবু লেগে রইলাম। বসে না থাকি বেগার খাটি। মাসখানে আগে জানতে পারলাম দয়ালহরি মজুমদারের নামে একজন পাঁচ হাজার টাকার মামলা ঠুকে দিয়েছে। দয়ালহরি বুড়োর ভাবগতিক দেখে মনে হল সে কেটে পড়বার মতলবে আছে। দিন কয়েক পরে হঠাৎ একদিন প্ৰভাত এসে উপস্থিত। প্ৰভাতকে আগে দেখিনি, এই প্রথম দেখলাম। বুড়ো তাকে ঢুকতেই দিচ্ছিল না, তারপর ঘরে এনে বসালো। দোর বন্ধ করে কথাবাতা হল, আমি জানলায় কান লাগিয়ে শুনলাম। প্ৰভাত বলছে, আমি আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি, দোকান বাঁধা রেখে যেখান থেকে হোক পাঁচ হাজার টাকা যোগাড় করব, আপনি হ্যান্ডনোটের টাকা শোধ করে দিন। বুড়ো পাঁচ হাজার টাকার বদলে প্ৰভাতের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী হল।
‘এদিকে গদানন্দর সঙ্গে—ভাল কথা, জগদানন্দ অধিকারীর ডাক-নাম গদানন্দ-শিউলীর ভেতরে ভেতরে কিছু চলছিল। গদানন্দ সম্বন্ধে যা জানতে পেরেছি, মেয়ে ধরা ওর পেশা, বেটা দালাল। সে যাহোক, হস্তাখানেক পরে প্রভাত একটা ছোট্ট অ্যাটাচি-কেস হাতে নিয়ে এল; বুঝলাম টাকা এনেছে। তারপর জানালায় কান লাগিয়ে শুনলাম, বুড়ো বলছে, তুমি ভাল ছেলে, অনাদি হালদার তোমার নামে মিছে কথা বলেছিল। আমি তোমার সঙ্গে শিউলীর বিয়ে দেব। কিন্তু শ্রাবণ মাসে আর বিয়ের দিন নেই, অস্ত্ৰাণ মাসে বিয়ে হবে। প্রভাত খুশি হয়ে চলে গেল।
‘তারপর কি ব্যাপার হল জানি না, গত ৭ই আগস্ট পড়াতে গিয়ে শুনলাম গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে উধাও হয়েছে। বুড়োর সাজিশ ছিল। কিনা বলতে পারি না, আমার বিশ্বাস বুড়েই নাটের গুরু। যাহোক, সেদিন সন্ধ্যেবেলা প্রভাত এল। খুব খানিকটা চেঁচামেচি হল। প্রভাত টাকা ফেরত চাইল, বুড়ো হাত উল্টে বলল, টাকা কোথায় পাব, শিউলী আর গদানন্দ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। প্রভাত রাগে ধুকতে ধুকতে ফিরে গেল। বেচারার জাতও গেল পেটও ভরল না।
‘কাল সকালবেলা পড়াতে গিয়ে দেখি বাড়ির দরজা খোলা, বাড়িতে কেউ নেই। বুড়ো ছেলেটাকে নিয়ে কেটে পড়েছে।’
গল্প শেষ করিয়া বিকাশ একটা বিড়ি ধরাইয়া ফেলিল, বলিল, ‘এসব খবর আপনার কাজে লাগবে কিনা জানি না। স্যার, কিন্তু এর বেশি আর কিছু যোগাড় করা গেল না।’
‘সব খবর কাজের খবর?–ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া রহিল, তারপর চোখ খুলিয়া বলিল, ‘গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে কোথায় গেছে আপনি জানেন না বোধহয়?’
‘না। যদি বলেন খুঁজে বার করতে পারি।’
ব্যোমকেশ একটু মৌন থাকিয়া বলিল, ‘আর একটা কোজ আপনাকে করতে হবে।’
এই সময় দরজায় টোকা পড়িল।
দ্বার খুলিয়া দেখি প্রভাত। তাহার চুল উল্কখুষ্ক, মুখ শীর্ণ, চেখভরা ক্লান্তি। তাহাকে দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন, প্রভাতবাবু্, আমরা ফিরেছি। খবর পেলেন কোত্থেকে?’
প্রভাত চেয়ারে বসিল। বিকাশকে সে লক্ষ্যই করিল না; বিকাশও তক্তপোশের এক কোণে এমনভাবে গুটিসুটি হইয়া বসিল যে প্রায় অদৃশ্য হইয়া গেল। প্রভাত বলিল, ‘খবর পাইনি, দেখতে এলাম। যদি এসে থাকেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ। কেষ্টবাবু মারা গেছেন। আপনি শোনেননি বোধহয়।’
প্রভাত কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল, যেন কেষ্টবাবুর মরা-বাঁচা সম্বন্ধে তাহার তিলমাত্র কৌতুহল নাই।
‘না, শুনিনি। কি হয়েছিল?’
‘কাল রাত্রে কেউ তাকে ছুরি মেরেছিল।’
উদাসীনকণ্ঠে প্ৰভাত বলিল, ‘ও–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক ওকথা। দয়ালহরিবাবুর নামে নিমাই নিতাই পাঁচ হাজার টাকার হ্যান্ডনোটের উপর নালিশ করেছে জানেন নিশ্চয়।’