আদিম রিপু

প্ৰভাতের মুখ বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিল। সে বলিল‌, ‘জানি। কিন্তু ওকথাও যেতে দিন‌, ব্যোমকেশবাবু। মানুষের অ-মনুষ্যত্ব দেখে দেখে আমার মন বিষিয়ে গেছে। আমি আপনাকে জানাতে এসেছিলাম যে‌, আর আমার এখানে মন টিকছে না‌, আমি শীগগিরই চলে যাব।’

‘সে কি‌, কোথায় যাবেন?’

‘তা এখনও ঠিক করিনি। পাটনায় ফিরে যেতে পারি। যেখানেই যাই দু’ মুঠো জুটে যাবে। কলকাতায় আর নয়।’

‘কিন্তু–আপনার দোকান?’

‘দোকান বিক্রি করে দেব–’ প্ৰভাতের মুখ ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল‌, সে আমার দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘অজিতবাবু্‌, আপনার জানাশোনা কেউ আছে‌, যে বইয়ের দোকান কিনতে পারে? বেশি দাম আমি চাই না। তিন হাজার-আড়াই হাজার পেলেও আমি বিক্রি করে দেব।’

ভাবিতে লাগিলাম‌, জানাশোনার মধ্যে এমন কে আছে যে‌, বইয়ের দোকান কিনিতে পারে! হঠাৎ ব্যোমকেশ এক অদ্ভুত কথা বলিয়া বসিল‌, ‘আমরা কিনতে পারি। আমি আর অজিত কিছুদিন থেকে পরামর্শ করছি একটা বইয়ের দোকান খুলব। অজিত নিজে লেখক‌, ও চালাতে পারবে। আপনার দোকানটা যদি পাওয়া যায় তাহলে তো ভালোই হয়।’

প্রভাতের মুখে একটু সজীবতা দেখা দিল‌, সে বলিল‌, ‘আপনারা নেবেন? তার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? আপনার নিলে দোকান বিক্রি করেও আমার দুঃখ হবে না। তাহলে–’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কত টাকার বই আছে আপনার দোকানে?’

প্রভাত বলিল‌, ‘হিসেব না দেখে কিছু বলতে পারি না‌, কিন্তু চার হাজার টাকার কম হবে না।’

‘বেশ‌, কাল সকালে গিয়ে আমরা আপনার হিসেবপত্র দেখব। দোকানের ওপর মর্টগেজ নেই তো।’

‘আজ্ঞে না।’

‘তাহলে কথা রইল‌, কাল আমরা আপনার কাগজপত্র দেখব‌, স্টক মিলিয়ে নেব। যা ন্যায্য দাম তাই আপনি পাবেন। কিন্তু একটা কথা। ১৫ই আগস্ট সকালে আমাদের দখল দিতে হবে। স্বাধীনতার প্রথম প্ৰভাতে ব্যবসা আরম্ভ করতে চাই।’

‘তাই হবে। যখন দখল চাইবেন তখনই দেব। আজ উঠি‌, হিসেবের কাগজপত্র ঠিক করে রাখতে হবে।’

‘আচ্ছা। ভাল কথা‌, নৃপেনবাবু এখনও আছেন?’

‘আছেন। তাঁকে অবশ্য বলে দিয়েছি যে আমি দোকান রাখব না। তিনি অন্য চাকরি খুঁজছেন‌, পেলেই চলে যাবেন।–আপনারা কি তাঁকে রাখবেন?’

‘রাখতেও পারি। তাকে একবার এখানে পাঠিয়ে দেবেন।’

‘দোকানে গিয়েই পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা‌, নমস্কার।’

প্রভাত দ্বারের বাহিরে যাইবামাত্র ব্যোমকেশ এক লাফ দিয়া বিকাশকে ধরিল‌, দ্রুত-হ্রস্ব কণ্ঠে তাহার কানে কানে কথা বলিয়া তাহার হাতে কয়েকটা নোটি গুজিয়া দিল। আমি কেবল তাহার কািল শুনতে পাইলাম মনে থাকে যেন কাল হৰি বাটো পর্যন্ত একটি আপনার নেই।’

বিকাশ একবার দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়িল‌, তারপর জ্যা-মুক্ত তীরের মত সাঁ করিয়া বাহির হইয়া গেল।

ঘর খালি হইয়া গেলে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কাণ্ডকারখানা কি?’

ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া চেয়ারে অঙ্গ প্রসারিত করিল‌, ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল‌, ‘একটা মস্ত সুযোগ হাতে এসেছে‌, অজিত‌, এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয়।’

‘কোন সুযোগের কথা বলছ?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এই ধরে বইয়ের দোকানটা। যদি পাওয়া যায়‌, ছাড়া উচিত কি? বইয়ের ব্যবসা খুব লাভের ব্যবসা; তুমিও মনের মত একটা কাজ পাবে। শুধু বই লিখে আজকাল কিছু হয় না। দেখছ তো‌, তোমাদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমান সাহিত্যিক তাঁরা গুটি গুটি ব্যবসায়ে ঢুকে পড়েছেন এবং বেশ দুধে-ভাতে আছেন।’

কথাটা সত্য। বইয়ের ব্যবসায় পয়সা আছে‌, বিশেষত যদি স্কুল-পাঠ্য পুস্তকের বাজার কোণ-ঠাসা করা যায়। তবু মৌখিক আপত্তি তুলিয়া বলিলাম‌, কিন্তু এই দুঃসময়ে হঠাৎ এতগুলো টাকা বার করা কি ভাল?’

সে বলিল‌, দু’জনে ভাগাভাগি করে দিলে গায়ে লাগবে না। তুমি হবে খাটিয়ে অংশীদার‌, আর আমি-ঘুমন্ত অংশীদার।’

আধা ঘণ্টা পরে নৃপেন আসিল। বলিল‌, ‘প্রভাতবাবু পাঠালেন। আপনি আমায় ডেকেছেন?’

‘হ্যাঁ‌, বসুন। ঐ চেয়ারে।’ ব্যোমকেশ কঠিন চক্ষে কিয়ৎকাল তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনার সব কীর্তিই আমি জানতে পেরেছি। রমেশ মল্লিক। আমার বন্ধু।’

ন্যাপা চমকিয়া কাষ্ঠমূর্তিতে পরিণত হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনাদি হালদারের আলমারির চাবি আপনি তৈরি করেছিলেন। আলমারিতে অনেক টাকা ছিল‌, সে টাকা কোথায় গেল? আমি যদি পুলিসকে খবর দিই তারা জানতে চাইবে। আপনি কী উত্তর দেবেন?

ন্যাপা অধর লেহন করিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি কথাটা পুলিসের কানে না তুলতে পারি‌, যদি আপনি আমার একটা কাজ করেন।’

ন্যাপার কণ্ঠ হইতে ভাঙা-ভাঙা আওয়াজ বাহির হইল‌, ‘কি কাজ?’

‘আর একটা চাবি তৈরি করে দিতে হবে।’

১৬

কবি হেমচন্দ্ৰ লিখিয়াছিলেন‌, পোহায় আগস্ট নিশি একত্রিশা বাসরে। তারপর কতকাল কাটিয়া গিয়াছে‌, প্রথম পৌর স্বয়ংপ্ৰভুতার সেই দিনটিকে স্মরণ করিয়া রাখে। এমন কেহ বাঁচিয়া নাই। আবার আর একটি আগস্ট নিশি পোহাইল। এবারও পর্ব ঘরে ঘরে‌, এবারও বাসাড়ে বাসিন্দা বেওয়া বেশ্যা করে সোর। কেবল পটভূমিকা আরও বিস্তৃত হইয়াছে‌, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

সকালে ঘুম ভাঙিয়া চিন্তা করিতে বসিলাম। এই যে ভারতবর্ষ স্বাধীন হইল ইহাতে আমার কৃতিত্ব কতটুকু? একটা পতাকা নাড়িয়াও তো সাহায্য করি নাই। (ব্যোমকেশ দিল্লীতে গিয়া সাত মাস ধরিয়া কিছু কাজ করিয়াছে। ) আমার মত শত সহস্ৰ মানুষ আছে যাহারা কিছুই করে নাই‌, অথচ তাহারা স্বাধীনতার ফল উপভোগ করিবে। একজন নীেকার দড়ি টানে‌, দশজন নদী পার হয়। ইহাই যদি সংসারের রীতি‌, তবে কর্ম ও কর্মফলের যোগাযোগ কোথায়?

0 Shares