ব্যোমকেশকে আমার আধ্যাত্মিক সমস্যার কথা বলিলাম। সে বলিল, ‘স্বাধীনতা পরের চেষ্টায় পেয়েছি, কিন্তু নিজের চেষ্টায় তাকে সার্থক করে তুলতে হবে। কাজ এখনও শেষ হয়নি।’
বেলা সাড়ে ন’টার সময় ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, এবার বেরুনো যাক। প্ৰভাতের বাসা হয়ে তার দোকানে যাব।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘প্ৰভাতের বাসায় কী দরকার?’
মৃদু হাসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘ননীবালা দেবীকে বড় দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
বৌবাজারের বাসার নিম্নতলে অনিবাৰ্য ষষ্ঠীবাবু হুঁকা-হাতে বিরাজমান। আমাদের দেখিয়া চকিতভাবে হুঁকা হইতে মুখ সরাইলেন। ব্যোমকেশ মিষ্টস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ওপরতলার সঙ্গে এখন আর কোনও গণ্ডগোল নেই তো?’
ষষ্ঠীবাবু উদ্বেগপূর্ণ চক্ষে চাহিয়া বলিলেন, ‘না-হ্যাঁ-না, গণ্ডগোল আমার কোনও কালেই ছিল না, আমি বুড়ো মানুষ, কারুর সাতেও নেই, পাঁচেও নেই-’
ব্যোমকেশ হাসিল, আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেলাম।
সিঁড়ির দরজা খুলিয়া দিল একটি দাসী। অপরিচিত দু’জন লোক দেখিয়া সে সরিয়া গেল, আমরা প্রবেশ করিলাম। যে ঘরটিতে পূর্বে একটি কেঠো বেঞ্চি ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেই ঘরটিকে কয়েকটি আরামপ্রদ চেয়ার দিয়া সাজানো হইয়াছে, দেয়ালে রবি বমরি ছবি। ননীবালা দেবী বৃহৎ একটি চেয়ারে বসিয়া চোখে চশমা আটিয়া একটি প্রখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখিতেছেন; তাঁহার হাতে পেন্সিল।
ননীবালা দেবীর বেশভূষা দেখিয়া তাক লাগিয়া যায়। চকচকে পাটের শাড়ির উপর লতা-পাত কাটা ব্লাউজ, দুই বাহুতে মোটা মোটা তাগা ও চুড়ি; সোনার হইতে পারে, গিলটি হওয়াও অসম্ভব নয়। মুখে গৃহিণী-সুলভ গাম্ভীর্য। ননীবালা যে অনাদি হালদারের রাহু গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়া নিজ মূর্তি ধারণ করিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ নাই।
ননীবালা আমাদের দেখিয়া একটু থাতমত হইলেন, তারপর হারমোনিয়ামের ঢাকনি খুলিয়া সম্ভাষণ করিলেন, ‘আসুন আসুন। কেমন আছেন?—ওরে চিনিবাস, দু’ পেয়ালা চা নিয়ে আয়। ব্যোমকেশবাবু্, একটু মিষ্টিমুখ-?’
‘না না, ওসব কিছু দরকার নেই। আমরা প্রভাতবাবুর খোঁজে এসেছিলাম।’
‘প্ৰভাত! সে তো আটটার সময় দোকানে চলে গেছে। —একটু বসবেন না?’
চেয়ারে নিতম্ব ঠেকাইয়া বসিলাম। শুধু ঝি নয়, চিনিবাস নামধারী ভৃত্যও আছে, সম্ভবত রাঁধুনীও নিযুক্ত হইয়াছে। শুক্রের মহাদশা না পড়িলে হঠাৎ এতটা বাড়-বাড়ন্ত দেখা যায় না।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা কি করছেন?’
ননীবালা বলিলেন, ‘ক্রসওয়ার্ড পাজল ভাঙছি। জানেন, আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি, একুশ হাজার টাকা।’ তাঁহার কণ্ঠে হারমোনিয়ামের সপ্তসুর গিটকিরি খেলিয়া গেল।
গয়নাগুলা। তবে গিলটির নয়। আমরাও কিছুদিন ক্রসওয়ার্ডের ধাঁধা ভাঙিবার চেষ্টা করিতেছিলাম; কিন্তু আমাদের ভাঙা কপাল, ধাঁধা ভাঙিতে পারি নাই।
অভিনন্দন জানাইয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ তাহলে উঠি। নৃপেনবাবুও কি দোকানে গেছেন?’
ননীবালা অপ্ৰসন্ন স্বরে বলিলেন, না। কাল থেকে ওর কি হয়েছে, ঘরে দোর বন্ধ করে আছে। কী যে করছে ওই জানে, খাওয়া-দাওয়ার সময় নেই, দোকানে যাওয়া নেই-ওকে দিয়ে আর দেখছি আমাদের চলবে না।’
আমরা বিদায় লইলাম। পথে যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্ৰভাত যে দোকান বিক্রি করে দিচ্ছে এ খবর বোধহয় ননীবালা জানেন না।’
দোকানের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া ব্যোমকেশ একবার এদিক ওদিক চাহিল তারপর বলিল, ‘তুমি দোকানে যাও, আমি আসছি। জুতোয় একটা পেরেক উঠেছে।’
দোকানের সামনা-সামনি রাস্তার অপর পারে গোলদীঘির দেয়াল ঘেঁষিয়া এক ছোকরা জুতা মেরামত করার সরঞ্জাম লইয়া বসিয়াছিল, ব্যোমকেশ তাহার কাছে গিয়া জুতা মেরামত করাইতে লাগিল। আমি দোকানে প্ৰবেশ করিলাম।
প্রভাত হিসাবের খাতাপত্ৰ লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল, বলিল, ‘এই যে! ব্যোমকেশবাবু এলেন না?’
‘আসছে। আপনার হিসেব তৈরি?’
‘হাঁ। এই দেখুন না।’
আমি হিসাবে দেখিতে বসিলাম। কিছুক্ষণ পরে ব্যোমকেশ আসিয়া যোগ দিল; হিসাব পরীক্ষা শেষ করিতে বেলা দুপুর হইয়া গেল। আমরা উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমরা তিন হাজার টাকাই দেব। কাল সকাল আটটার সময় চেক পাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে দখল দিতে হবে।’
‘যে আজ্ঞে।’
সেদিন অপরাহ্নে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ইন্দুবাবুকে টেলিফোন কর না, গদানন্দর সাম্প্রতিক খবর যদি কিছু পাওয়া যায়।’
বলিলাম, ‘গদানন্দ তো পালিয়েছে, তাকে ইন্দুবাবু কোথায় পাবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে পালিয়েছে, কিন্তু ফেরারী হয়নি। শিউলী সাবালিকা, সে যদি কারুর সঙ্গে বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে থাকে, তাতে ফৌজদারি হয় না। গদানন্দ খুব সম্ভব তাকে নিজের বাসায় তুলেছে।’
‘আচ্ছা, দেখি—‘
ইন্দুবাবুকে ফোন করিলাম। তিনি আমার প্রশ্ন শুনিয়া বলিলেন, ‘গদানন্দর খবর জানি বৈকি। তাকে নিয়ে সিনেমা-মহল এখন সরগরম। সেদিন আপনাদের বলেছিলাম। কিনা। গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে ভেগেছে, তারপর তাকে রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে করেছে। এই নিয়ে গদানন্দর তিনবার হল।’
‘তিনবার। তিনবার কী?
‘তিনবার বিয়ে।’
‘বলেন কি, আরও দুটো বউ আছে?’
‘এখন আর নেই। প্রথম বিউটা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল, কিন্তু সিনেমায় সুবিধে হল না; ক্যামেরায় তার চেহারা ভাল এল না। সে হঠাৎ একদিন হার্ট ফেল করে মারা গেল। তারপর গদানন্দ আর একটা মেয়েকে ফুসলে এনে বিয়ে করল। এ মেয়েটা অভিনয় ভালই করত। কিন্তু personality ছিল না, দেখা গেল তাকে দিয়ে হিরোইনের পার্ট চলবে না। সেটাও বেশিদিন টিকল না।’