আদিম রিপু

‘কি সর্বনাশ! আপনার কি মনে হয় গদানন্দ বৌ দুটোকে-অ্যাঁ!’

‘ভগবান জানেন। শিউলীর অবশ্য মাইকের গলা ভাল। এই যা ভরসা।’

ব্যোমকেশকে বাতা শুনাইলাম। সে আপন মনে মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল‌, তারপর বলিল‌, ‘গদানন্দের বংশপরিচয় জানতে ইচ্ছে করে। এক পুরুষে এতটা হয় না।’

ক্ৰমে সন্ধ্যা হইল। নগর দীপাবলীতে সজ্জিত হইয়া আর একটি দীপান্বিতা রাত্রিকে স্মরণ করাইয়া দিল। ঘরে ঘরে দোকানে দোকানে রেডিওর জলদমন্দ্র স্বর অন্য সব শব্দকে ডুবাইয়া দিল। সকলেরই কান পড়িয়া আছে দিল্লীর পানে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে স্বাধীনতার উদ্বোধন হইবে।

সাতটার সময় চকিতের ন্যায় নৃপেন আসিল‌, দ্বারের নিকট হইতে ব্যোমকেশের হাতে একটি চকচকে চাবি দিয়া আলাদীনের জিনের মত অদৃশ্য হইল।

দশটার সময় আমরা আহার শেষ করিলাম।

সাড়ে এগারটার সময় ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে বলিল‌, ‘আমরা এখনি বেরুব‌, কখন ফিরব ঠিক নেই। তুই জেগে থাকিস। আর একটা আংটায় কাঠকয়লা দিয়ে আগুন করবার যোগাড় করে রাখিস। আমরা ফিরে এলে আগুন জ্বালবি।’

পুঁটিরাম ‘যে আজ্ঞে’ বলিয়া প্ৰস্থান করিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, কাঠকয়লার আগুন কি হবে?’

সে বলিল‌, ‘অতীতকে ভস্মীভূত করে ফেলতে হবে।’

মধ্যরাত্রির কিছু আগে আমরা বাহির হইলাম। ঘরে ঘরে শঙ্খ বাজিতেছে—

গোলদীঘির চারি পাশের দোকানগুলি কিন্তু বন্ধ। দোকানদারেরা বোধকরি নিজ নিজ ঘরে গিয়া রেডিও যন্ত্র আঁকড়াইয়া বসিয়া আছেন। এত রাত্রে এদিকের রাস্তাগুলিও জনবিরল হইয়া’ আসিয়াছে।

একটি ল্যাম্পপোস্টের ছায়াতলে একজন লোক দাঁড়াইয়া বিড়ি টানিতেছিল, আমরা নিকটবর্তী হইলে বাহির হইয়া আসিল। দেখিলাম বিকাশ।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছু খবর আছে নাকি?’

বিকাশ বলিল‌, ‘না। প্রভাতবাবু সাড়ে ন’টার সময় দোকান বন্ধ করে চলে গেছেন।’

‘হাতে কিছু ছিল?’

‘না।‘

‘তারপর আর কেউ আসেনি?’

‘না।‘

‘আচ্ছা‌, আসুন তাহলে।’

তিনজনে রাস্তা পার হইয়া প্ৰভাতের দোকানের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। ব্যোমকেশ চাবি দিয়া দ্বারের তালা খুলিল; বেশ অনায়াসে তালা খুলিয়া গেল। তারপর চাবি বিকাশের হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা দু’জনে ভেতরে যাচ্ছি‌, আপনি তালা বন্ধ করে দিন। কতক্ষশ অপেক্ষা করতে হবে বলা যায় না। আপনি যেমন ছিলেন তেমনি থাকবেন। যদি কেউ দোর খুলে ভেতরে ঢোকে‌, আপনার কিছু করবার দরকার নেই।’

‘আচ্ছা‌, স্যার।’

আমরা অন্ধকার দোকানে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশের পকেটে বৈদ্যুতিক টর্চ ছিল‌, সে তাহা জ্বলিয়া ঘরের চারিদিকে ফিরাইল। সারি সারি বইগুলা যেন দাঁত বাহির করিয়া নীরবে: হাসিল। আমরা পিছনের কুঠুরিতে প্রবেশ করিয়া তক্তপোশের কিনারায় বসিলাম‌, মাঝের দরজা একপাট খোলা রহিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এ ঘরে বই নেই‌, এ ঘরে বোধহয় আসবে না।’

আমি বললাম‌, ‘ব্যোমকেশ রক্তপুরে আমরা প্ৰভাতের দোকানে কি করছি জানতে পারি কি?’

ব্যোমকেশ আমার কানে কানে বলিল‌, ‘গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা‌, খাপ পেতেছেন গোষ্টমামা।’

বইয়ের দোকানের একটা গন্ধ আছে‌, নূতন বইয়ের গন্ধ। এই গন্ধ সাধারণত টের পাওয়া যায় না‌, কিন্তু গভীর রাত্ৰে দোকানের মধ্যে বন্ধ থাকিলে ধীরে ধীরে অনুভব হয়। একটু ঝাঁজালো‌, নাক সুড় সুড় করে‌, হাঁচি আসে।

তার উপর নিজেদের নিশ্বাসের কার্বন-ডায়কসাইড আছে। ঘণ্টাখানেক প্রতীক্ষ্ণ করিবার পর অনুভব করিলাম‌, ঘরের বাতাস ভারী হইয়া আসিতেছে। গরমে প্ৰাণ আনচান করিয়া উঠিল। বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ—‘

ব্যোমকেশ বজ্রমুষ্টিতে আমার হাত চাপিয়া ধরিল‌, তাহার গলা হইতে চাপা শীৎকার বাহির‌ হইল ‘স, স্‌ স্‌–।’

আর একটি শব্দ কানে আসিল‌, কেহ চাবি দিয়া দ্বারের তালা খুলিতেছে। দরজা একটু ফাঁক হইল‌, বাহিরের আলো আচ্ছাভ পদার মত ধীরে ধীরে প্রসারিত হইল। একটি ছায়ামূর্তি প্রবেশ করিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে কুঠুরির ভিতর হইতে দেখিতে লাগিলাম।

হঠাৎ দোকানঘরের মাঝখানে দপ করিয়া টর্চের আলো জ্বলিয়া উঠিল। আলোর দৃষ্টি ঊর্ধ্ব দিকে‌, সার্চ-লাইটের মত দেয়ালের উপর দিকে পড়িয়াছে। টর্চের পিছনে মানুষটিকে দেখা গেল না।

টর্চ হাতে লইয়া মানুষটি কাউন্টারের উপর লাফাইয়া উঠিল। আমরা পা টিপিয়া টিপিয়া কুঠুরির দ্বারের নিকট হইতে উঁকি মারিলাম। টর্চের আলো বইয়ের সর্বোচ্চ তাকের উপর পড়িয়াছে। মানুষটি হাত বাড়াইয়া একটি বই বাহির করিয়া লইল; আকারে আয়তনে অনেকটা ‘চিলন্তিকা’র মত। তারপর আর একটি বই বাহির করিল‌, তারপর আর একটি। এমনিভাবে পাঁচখানি বই লইয়া মানুষটি লাফাইয়া নীচে নামিল; কাউন্টারের উপর জ্বলন্ত টর্চ রাখিয়া একটি বাজার-করা থলিতে বইগুলি ভরিতে লাগিল।

থলিতে বইগুলি ভরা হইয়াছে‌, এমন সময় ব্যোমকেশ গিয়া মানুষটির কাঁধে হাত রাখিল‌, বলিল‌, ‘থলিটা আমায় দিন।’

মানুষটির গলায় করাতের মত দ্রুত নিশ্বাস টানার শব্দ হইল। তারপর ব্যোমকেশ তাহার মুখের উপর নিজের টর্চের আলো ফেলিল।

মুখখানা ভয়ে ও বিস্ময়ে বিকৃত হইলেও চেনা শক্ত নয়‌, প্ৰভাতের মুখ। তাহার চোখের শাদা অংশই অধিক দেখা যাইতেছে। সে মিনিটখানেক চাহিয়া থাকিয়া অভিভূত স্বরে বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু!’

‘হ্যাঁ‌, আমি আর অজিত। থলিটা দিন।’

প্রভাত একটু ইতস্তত করিল‌, তারপর থলি ব্যোমকেশের হাতে দিল। ব্যোমকেশ থলিটা আমার হাতে দিয়া বলিল‌, ‘অজিত‌, এটা রাখা। বইগুলো ভারি দামী।–প্রভাতবাবু্‌, এবার চলুন।’

0 Shares