প্ৰভাত আরও কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘কোথায় যেতে হবে? থানায়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আপাতত আমার বাসায়। আগে বইগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
তিনজনে দোকানের বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশের ইঙ্গিতে প্ৰভাত দ্বারে তালা লাগাইল। ফিরিয়া দেখি বিকাশ অলক্ষিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিকাশবাবু্, অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আপনার ছুটি। কাল সকালে একবার বাসায় আসবেন।’
‘যে আজ্ঞে, স্যার–’ বিকাশ অন্তর্হিত হইল। আমি ও ব্যোমকেশ প্ৰভাতকে মাঝখানে লইয়া বাসার দিকে চলিলাম।
১৭
তিনজনে আসিয়া আমাদের বসিবার ঘরে উপবিষ্ট হইয়াছি। প্রভাত ও আমি দুইটি চেয়ারে বসিয়াছি, ব্যোমকেশ তক্তপোশের উপর বইয়ের থলিটি লইয়া বসিয়াছে। রাত্রি প্রায় দুইটা; বাহিরে নগর-গুঞ্জন শান্ত হইয়াছে।
ব্যোমকেশের মুখ গভীর, একটু বিষন্ন। সে চোখ তুলিয়া একবার প্রভাতের পানে ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; প্রভাতের মুখে কিন্তু অপরাধের গ্লানি নাই, ধরা পড়বার সময় যে চকিত ভয় ও বিস্ময় তাহাকে অভিভূত করিয়াছিল, তাহা তিরোহিত হইয়াছে। সে এখন সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ, সকল প্রকার সম্ভাবনার জন্য প্ৰস্তুত।
ব্যোমকেশ একে একে বইগুলি থলি হইতে বাহির করিল। বোর্ডে বাঁধাই বাদামী রঙের বইগুলি, বাহির হইতে দৃষ্টি-আকর্ষক নয়। কিন্তু ব্যোমকেশ যখন তাহাদের পাতা মেলিয়া ধরিল, তখন উত্তেজনায় হঠাৎ দম আটকাইবার উপক্রম হইল। প্ৰত্যেক বইয়ের প্রত্যেকটি পাতা এক একটি একশত টাকার নোট।
ব্যোমকেশ বইগুলি একে একে পর্যবেক্ষণ করিয়া পাশে রাখিল, প্ৰভাতকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সবসুদ্ধ কত আছে বইগুলোতে?’
প্রভাত বলিল, ‘প্রায় দু’ লাখ। কিছু আমি খরচ করেছি।’
‘দয়ালহরি মজুমদারকে যে টাকা দিয়েছেন তা ছাড়া আর কিছু খরচ হয়েছে?’
প্ৰভাতের চোখের দৃষ্টি চকিত হইল; ব্যোমকেশ এত কথা কোথা হইতে জানিল এই প্রশ্নটাই যেন তাহার চক্ষু হইতে উঁকি মারিল। কিন্তু সে কোনও প্রশ্ন না করিয়া বলিল, ‘আরও কিছু খরচ হয়েছে, সব মিলিয়ে চোঁদ পনেরো হাজার।’
ব্যোমকেশ তখন বইগুলির উপর হাত রাখিয়া শাস্তকণ্ঠে বলিল, ‘প্রভাতবাবু্, এইগুলোর জন্যেই কি আপনি অনাদি হালদারকে খুন করেছিলেন?’
প্রভাত দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িল, ‘না, ব্যোমকেশবাবু।’
‘তবে কি জন্যে একাজ করলেন বলবেন কি?’
প্রভাত একবার যেন বলিবার জন্য মুখ খুলিল, তারপর কিছু না বলিয়া মুখ বন্ধ করিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি যদি না বলেন, আমিই বলছি।–শিউলীর সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিয়ে অনাদি হালদার নিজে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। এইজন্যে–কেমন?’
প্রভাত কিছুক্ষণ বুকে ঘাড় গুজিয়া যখন মুখ তুলিল, তখন তাহার রগের শিরাগুলো উচু হইয়া উঠিয়াছে। তাহার দাঁতের গড়নে যে হিংস্ৰতা আগে লক্ষ্য করিয়াছিলাম, কথা বলিবার সময় তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠিল; সে অবরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘হ্যাঁ। অনাদি হালদার শিউলীর বোপকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে রাজী করিয়েছিল–’ এই পর্যন্ত বলিয়া সে থামিয়া গেল, নীরবে বসিয়া যেন অন্তরের আগুনে ফুলিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম তাহলে।–কিন্তু আপনি কেষ্টবাবুকে মারতে গেলেন কেন?’
ক্ৰোধ ভুলিয়া প্রভাত সবিস্ময়ে ব্যোমকেশের পানে চোখ তুলিল। বলিল, ‘সে কি! কেষ্টবাবুর কথা আমি তো কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ সন্দেহ-কণ্টকিত দৃষ্টিতে প্ৰভাতকে বিদ্ধ করিল—’আপনি কেষ্ট দাসকে খুন করেননি?’
প্রভাত বলিল, ‘না, ব্যোমকেশবাবু। কেষ্টবাবু গত আট মাসে আমার কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিয়েছে। তার মরার খবর পেয়ে আমি খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু আমি তাকে খুন করিনি। বিশ্বাস করুন, আমি যদি খুন করতাম, আজ আপনার কাছে অস্বীকার করতাম না।’
ব্যোমকেশের মুখখানা ধীরে ধীরে প্রফুল্ল হইয়া উঠিতে লাগিল, যে বিষন্নতা কুয়াশার মত তাহার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা যেন কাটিয়া গেল। সে বলিল, ‘কিন্তু, কেষ্ট দাসকে তাহলে খুন করলে কে?’
‘তা জানি না। তবে—‘ প্ৰভাত ইতস্তত করিল।
‘তবে? প্রভাত একটু সঙ্কুচিতভাবে বলিল, ‘দশ-বারো দিন আগে বাঁটুল সর্দার আমার কাছে এসেছিল। বাঁটুলকে আপনারা বোধহয় চেনেন না।–’
‘খুব চিনি। এমন কি আপনার সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ তাও জানি। তারপর বলুন।’
‘বাঁটুল আমাকে কেষ্টবাবুর কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল; কেষ্টবাবু কে, অনাদিবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে কী জানে, এই সব। আমি বাঁটুলকে সব কথাই বললাম। তারপর—‘
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, বলিল, ‘যাক, এবার বুঝেছি। আপনাকে ব্ল্যাকমেল করে কেষ্ট দাসের টাকার ক্ষিদে মেটেনি, সে গিয়েছিল বাঁটুলকে ব্ল্যাকমেল করতে। অতিলোভে তাঁতী নষ্ট।’—ব্যোমকেশ হাঁক দিল, ‘পুঁটিরাম!’
পুঁটিরাম ভিতর দিকের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুঁটিরাম, তিন পেয়ালা চা হবে?’
পুঁটিরাম বলিল, ‘আজ্ঞে, দুধ নেই বাবু।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কুছ পরোয়া নেই, আদা দিয়ে চা তৈরি কর। আর কয়লার আংটা ঠিক করে রেখেছ?’
‘আজ্ঞে।’
‘বেশ, এবার তাতে আগুন দিতে পার।’
পুঁটিরাম প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রভাতবাবু্, আপনার মা-ননীবালা দেবী বোধহয় কিছু জানেন না?’
‘আজ্ঞে না।’ প্ৰভাত কিছুক্ষণ বিস্ময়-সন্ত্রমভরা চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আপনি কি সবই জানতে পেরেছেন, ব্যোমকেশবাবু?’